1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
ব্যবসা-বাণিজ্যবাংলাদেশ

ভোক্তার অধিকার রক্ষায় কী করছে ভোক্তা অধিদপ্তর

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
১৫ মার্চ ২০২৪

বাংলাদেশে ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান কাজ করলেও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরই মূল দায়িত্বে আছে৷ কিন্তু তাদের জনবল আর কর্মএলাকার সীমবদ্ধতার কারণে ভোক্তারা সব অভিযোগের প্রতিকার পান না৷

https://p.dw.com/p/4dfbl
বাংলাদেশে রমজানে ইফতারসামগ্রীর দোকানে কেনাকাটা করছেন মানুষ
অভিযোগের প্রক্রিয়া বেশ জটিল হওয়ায় অনেকে ভোক্তাই নিজেদের অভিযোগ দায়ের করতে পারেন নাছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS

একই সঙ্গে আছে আইন প্রয়োগে দ্বৈতনীতি৷

২০০৯ সালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন পাস হয়৷ এই আইনের অধীনে অধিদপ্তর বাজার তদারকি, ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণ এবং এই সংক্রান্ত অপরাধের বিচার ও নিস্পত্তি করে৷

তাদের কাজের মূল উদ্দেশ্য হলো ভোক্তা অধিকার বিরোধী কার্যক্রম প্রতিরোধ এবং অভিযোগ নিস্পত্তির মাধ্যমে ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণ৷

তবে আইনে ই-কমার্স, স্বাস্থ্যসেবা, টেলিকম, বাড়িভাড়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অন্তর্ভুক্ত নেই৷ সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান যেমনওয়াসা, ডেসা বা তিতাসের গ্রাহকদের কোনো অভিযোগ আমলে নিতে পারে না ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর৷ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে প্রচুর অভিযোগ আসে অধিদপ্তরে৷

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান জানান, ‘‘ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আইনে অন্তর্ভুক্ত না থাকলেও আমরা প্রতারণাসহ অন্য আইনে অভিযোগ গ্রহণ ও নিষ্পত্তি করি৷''

অধিদপ্তর যেভাবে কাজ করে

ভোক্তারা সরাসরি ও অনলাইনে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করতে পারেন৷ তারা অভিযানও পরিচালনা করে৷ এটা অভিযোগের ভিত্তিতেও হয় আবার অধিদপ্তর নিজেদের উদ্যোগেও করে৷ অভিযানের ক্ষেত্রে অন্যায্য দাম, প্রতারণা, ভেজাল ও মজুতের মতো বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়৷

ভোক্তা সংরক্ষণ অধিকার আইন অনুযায়ী অধিদপ্তর অভিযান পরিচালনা এবং বিচারিক কাজ দুইটিই এক সঙ্গে করে৷ আইনের ৭০ ধারায় তারা প্রশাসনিক ব্যবস্থার আওতায় জরিমানা, লাইসেন্স বাতিল, স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে কার্যক্রম বন্ধ করতে পারে৷ আইনের ৫৭ ধারায় ফৌজদারী ব্যবস্থা নিতে পারে৷ সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড অথবা দুইলাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড দিতে পারে৷ তারা আইনের ৬৬-৬৭ ধারায় ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারে৷ ক্ষতির চেয়ে পাঁচগুণ পরিমাণ আদেশ দেয়ার ক্ষমতা তাদের আছে৷

১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে ওষুধে ভেজাল, মিশ্রণ বা নকল ওষুধের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড৷ ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এই বিষয়ে অনুসন্ধান ও তদন্ত করতে পারেন৷ কিন্তু এর বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন না৷ ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে মামলাও করতে পারেন না৷ বিচারের দায়িত্ব বিশেষ ট্রাইব্যুনালের৷

তারা সরাসরি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে পারে না৷ জেলা প্রশাসনের সহায়তায় নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রের মাধ্যমে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা হয়৷

এর বাইরে এই অধিদপ্তর সভা-সেমিনারের মাধ্যমে সচেতনতামূলক কাজ করে৷ তাদের সব কাজের মূল লক্ষ্য হলো ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ৷

ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজারে অস্থিরতা তৈরি করছে: এস এম নাজের হোসেন

অভিযোগ ও নিষ্পত্তি

ভোক্তাদের অভিযোগ বাড়ছে৷ ২০২৩ সালে ২৬ হাজার ৬০৫টি অভিযোগ জমা পড়ে, যা তার আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১০ হাজার বেশি৷ ২০২২ সালে অভিযোগের সংখ্যা ছিল ১৬ হাজার ৫৪টি৷

২০১০ সালের ৬ এপ্রিল থেকে বাজার পর্যবেক্ষণ এবং অভিযোগ গ্রহণ ও নিষ্পত্তি শুরু করে অধিদপ্তর৷ গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এক লাখ ২৩ হাজার ৭৫৩টি অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা, যার সিংহভাগই ই-কমার্স ও এফ-কমার্সের বিরুদ্ধে৷ এর মধ্যে এক লাখ ২১ হাজার ৩৬০টি অভিযোগ নিষ্পন্ন হয়েছে৷

সংস্থাটি অভিযোগ ছাড়াও নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন বাজারে এ পর্যন্ত ৭২ হাজার ৯৩৭টি অভিযানে এক লাখ ৭০ হাজার ৯০৮টি প্রতিষ্ঠানকে শাস্তির আওতায় এনেছে৷ তাদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করেছে ১২০ কোটি ২৭ লাখ ৪৮ হাজার টাকার বেশি৷ এ ছাড়া ভোক্তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে ৯ হাজার ১৫০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকার বেশি জরিমানা করেছে৷ এর মধ্যে ২৫ শতাংশ হিসাবে অভিযোগকারীদের দেওয়া হয়েছে এক কোটি ৫৫ লাখ ৬৬ হাজার টাকার বেশি৷ বাকি ৭৫ শতাংশ অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয়েছে৷

২০২১ সালের পর থেকে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ই-কমার্সের বিরুদ্ধে ৩৪ হাজার ৮৪২টি অভিযোগ করা হয়৷ এর মধ্যে ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ছয় হাজার ৩৮৮টি৷ মোট অভিযোগের নিষ্পত্তি হয়েছে ১৫ হাজার ৪৩৮টি বা ৪৪ দশমিক ৩১ শতাংশ৷ অধিদপ্তরের হটলাইনেও বেড়েছে অভিযোগ৷ সংস্থাটির কল সেন্টার ১৬১২১-এ গত সাত মাসে ৩৫ হাজারের বেশি কল করে অভিযোগ করেছেন ভোক্তারা৷

জনবল ও আইনের সমস্যা

ভোক্তা অধিদপ্তরে ৮২ জন কর্মকর্তাসহ মোট জনবল ২৮০ জন৷ দেশের ১৭টি জেলায় ভোক্তা অধিদপ্তরের কোনো কর্মকর্তা নেই৷ আর উপজেলা পর্যায়ে এখনো তাদের কাজ সম্প্রসারিত হয়নি৷ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘‘কাজের তুলনায় জনবল আছে এখন ১০ ভাগের এক ভাগ৷ আর আমাদের কাজ উপজেলা পর্যন্ত সম্প্রসারিত হওয়া প্রয়োজন৷'' ২০০৯ সালের অর্গানোগ্রামে মোট অনুমাদিত জনবল ছিল ৩৬৬ জন৷ আরো ৪৫৭টি পদ সৃষ্টির আবেদন করা হলেও অনুমোদন মিলছে মাত্র ১২টির৷ এছাড়া আইন ও লজিস্টিক সাপোর্টে সমস্যা আছে৷ কর্মকর্তারা ভাড়া করা গাড়িতে অভিযানে যান৷ আর মেবাইল কোর্ট পরিচালনার সরাসরি এখতিয়ার নেই৷

তবে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাস টিটু বলেন, ‘‘উপজেলা পর্যায়ে ইউএনও এবং জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসকেরা আছেন৷ তারাই মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে পারেন৷ ফলে আমি মনে করি ভোক্তা অধিদপ্তরের জনবল বাড়ানো নয়, দরকার এটা নিয়ে প্রচার ও সচেতনতা৷ তারা পলিসি তৈরি করবেন৷ প্রশাসনের মাধ্যমে কার্যকর করা হবে৷'' তার কথা, ‘‘জনপ্রতিনিধি ও ক্যাবের মতো যেসব সংগঠন আছে তাদের বেশি করে সম্পৃক্ত করতে হবে৷ সবখানে পুলিশিং নয়, দরকার সচেতনতা ও অংশগ্রহণ৷''

কাজের তুলনায় আমাদের জনবল আছে এখন ১০ ভাগের এক ভাগ: এ এইচ এম সফিকুজ্জামান

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘‘আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ ঠিক মতো করা হয় না৷ বিশেষ ক্ষমতা আইনে মজুতদারীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড৷ ভোক্তা অধিদপ্তর চাইলে এই আইনে মামলা করতে পারে৷ তারা নিজেরা আইনটি প্রয়োগ করতে পারেন, কিন্তু মামলায় তো বাধা নেই৷ ডিসিরাও এই আইনে মামলা করেন না৷ তারা সবাই চান এখন মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে দেশ চালাতে৷ তারা নিজেরাই শাস্তি দিতে চান সবক্ষেত্রে৷ এটাই সমস্যা৷''

ভোক্তার অধিকার আদায় বত দূর?

কনজ্যুমারস অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘‘দেশের অনেক ভোক্তাই এখনো তাদের অভিযোগ জানাতে পারেন না৷ অভিযোগ নেয়া হয় প্রধানত অনলাইনে৷ অধিকাংশ মানুষই অনলাইনে অভ্যস্ত নয়৷ আর অভিযোগ অনেক জটিল প্রক্রিয়া৷ অনেক কাগজপত্র লাগে৷ সেটা আবার প্রমাণ করতে হয়৷ ক্রেতা যখন পণ্য কেনেন তখন তো তিনি প্রতারিত হওয়ার আগাম প্রস্তুতি রাখেন না৷ ফলে তারা কাগজপত্রও সংরক্ষণ করেন না৷ আবার অনেক প্রতিষ্ঠান বিক্রয় রসিদ দেয় না৷''

‘‘তবে এই ব্যক্তি পর্যায়ের চেয়ে বড় বিষয় হলো ক্রেতারা এখন সবাই প্রতারিত হচ্ছেন একযোগে৷ ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াচ্ছে৷ তারা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজারে অস্থিরতা তৈরি করছে৷ তার বিরুদ্ধে তো কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না৷ ব্যবসায়ীদের কাছে ক্রেতারা জিম্মি তার প্রতিকার কে দেবে?''

‘‘আর নিত্যপণ্যের ওপর সরকার বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি কর বসায়৷ ব্যবসায়ীরা সেটা ক্রেতার কাছ থেকে আদায় করে৷ ফলে অস্বাভাবিক দাম বাড়ার পিছনে সরকারেরও হাত আছে৷ এটা আমাদের আশপাশের দেশে হয় না৷ তারা এসেনশিয়াল প্রোডাক্টে এত কর বসায় না,'' বলেন নাজের হোসেন৷

মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘‘ভোক্তা অধিদপ্তরকে আমরা ছোট খাটো ব্যবসায়ী ও দোকানদাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে দেখি৷ কিন্তু যারা আমদানি করে, মজুত করে, যারা সংকট তৈরি করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখি না৷''

এর জবাবে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘‘সরকারের দায়িত্ব পণ্যের সাপ্লাই ঠিক রাখা৷ আমরা সেটা আশা করি আগামী তিন মাসের মধ্যে করতে পারব৷ তবে হঠাৎ করে কঠিন কোনো ব্যবস্থা নেয়া যায় না৷ তাতে সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়৷''

২০২২ সালের ছবিঘর