বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের রেকর্ড!
২১ নভেম্বর ২০১৮বুধবার ভোরে সিলেটের দক্ষিণ সুরমা এলাকায় র্যাবের মাদকবিরোধী অভিযানের সময় ‘বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হয়েছে আব্দুস শহীদ (৪২) নামে একজন৷ র্যাব দাবি করেছে, সে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের একজন তালিকাভূক্ত মাদক ব্যবসায়ী৷
প্রায় একই সময়ে মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ি এলাকায় মাদকবিরোধী অভিযানে র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হয়েছেন আবুল হোসেন (৫০) নামে একজন৷ তিনিও মাদকব্যবসায়ী বলে জানিয়েছে র্যাব৷
এদিকে টেকনাফে বুধবার ভোরে ‘বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হয়েছে নজির আহমদ (৩৮) ও আবদুল আমিন(৩৫)৷ পুলিশ দাবি করেছে, কক্সবাজারের টেকনাফে মেরিন ড্রাইভে ইয়াবা চালান খালাসকে কেন্দ্র করে দুই ইয়াবা ব্যবসায়ী গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনায় ওই দুই জন নিহত হয়৷ পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ইয়াবা ও অস্ত্রসহ তাদের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে৷
বাংলাদেশে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হয় চলতি বছরের মে মাসে৷ আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসবে ১৫ মে থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ মাসে মাদকবিরোধী অভিযানে নিহত হয়েছে ২৭৬ জন৷ আর জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন মোট ৪৩৭ জন৷
২০১৭ সালে ১২ মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল ১৬২ টি৷ ২০১৬ সালে ১৯৫, ২০১৫ সালে ১৯২, ২০১৪ সালে ১৫৮ এবং ২০১৩ সালে নিহত হয়েছিলেন ২০৮ জন৷
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ভোটের বছর ২০১৮ সালের ১০ মাসে ২০১৭ সালের ১২ মাসের চেয়ে তিনগুন বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যা হয়েছে৷
বাংলাদেশে মে মাসে শুরু হওয়া মাদকবিরোধী অভিযান নিয়ে বিতর্ক আছে৷ ২৬ মে রাতে টেকনাফের কাউন্সিলর একরামুল হককে হত্যার পর এই অভিযান প্রশ্নের মুখে পড়ে৷ তারপর বেশ কিছুদিন অভিযান থমকে যায়৷ বিরতি দিয়ে শুরুর পর এখন তা আবার নতুন করে গতি পাচ্ছে৷ মাদকবিরোধী অভিযানে প্রথম মাসেই নিহত হয় ১৩৮ জন আর গ্রেপ্তার হয় ১০ হাজারেরও বেশি৷ এই অভিযানে গ্রেপ্তারবাণিজ্য এবং টাকা না পেয়ে ‘ক্রসফায়ারের' অভিযোগও আছে৷
বাংলাদেশ মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা মানবাধিকার কর্মীরা অনেক বছর ধরেই এই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকলেও শাসকগোষ্ঠী কখনোই আমলে নেয়নি৷ আর এখন কেউ এর শিকার হলেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয় মাদকের সঙ্গে জড়িত৷ যে-কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত থকালেই তো তাকে হত্যা করা যায় না৷ বিচারে সোপর্দ না করে হত্যা করা সংবিধান, আইন ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন৷ শাসকগোষ্ঠী একটা শর্টকাট পথ বেছে নিচ্ছে৷ আর যারা এই কাজ করছেন, তারাও মনে করছেন সরকার আমাদের ওপর নির্ভরশীল৷''
তিনি বলেন, ‘‘এখন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দু'টি স্টাইল আমরা খেয়াল করছি৷ একটা হলো বন্দুকযুদ্ধ এবং আরেকটা হলো লাশ উদ্ধার৷ লাশ উদ্ধারের সংখ্যা এখন বাড়ছে৷''
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘নির্বাচনের বছরে একটু হাওয়া বদলের প্রবণতা থাকে৷ তখন অনেক কিছুই ঢিলেঢালা হয়ে যায়৷ এর সুযোগ নেয় অনেকেই৷ ফলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডও বেড়ে যায়৷''
মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এ বছর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাওয়ার দুটি কারণ আছে বলে আমার কাছে মনে হয়েছে৷ মে মাস থেকে শুরু হওয়া চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে এরই মধ্যে দু'শরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন৷ আর এটা নির্বাচনের বছর৷ আমরা অতীতে দেখেছি, নির্বাচনসহ বিশেষ বিশেষ সময়ে ক্রসফায়ার, বন্দুযুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বেড়ে যায়৷''
মাদকবিরোধী অভিযানের পরও মাদকের ব্যবসা এবং মাদক ব্যাহারকারী কমছে না৷ নতুন মাদকবিরোধী আইন সংসদে পাশ হয়েছে৷ তাতেও কোনো ফল এখানো দেখা যাচ্ছে না৷ তারপরও কেন এই অভিযান? কেন এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড? নূর খান মনে করেন, ‘‘যে-কেনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় এই পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে একটা সাময়িক উপশম পাওয়ার চেষ্টা করা হয়৷ আসলে তা শেষ পর্যন্ত কাজে আসে না৷ আরেকটি হলো নির্বাচনের আগে একটা ভয়ার্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা, যাতে প্রতিবাদী মানুষও কথা বলতে সাহস না পায়৷''
আপনার মতামত জানান, লিখুন নীচের ঘরে৷