মগজের গ্রিড সেল আমাদের জিপিএস
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫মানুষ যখন পথ খোঁজে, তখন তাকে ‘আলো' দেখায় মস্তিষ্কের এক কোষ সমষ্টি, যাদের নাম ‘গ্রিড সেল'৷ ইঁদুরদের মধ্যে এই গ্রিড সেল প্রথম আবিষ্কার করেন নরওয়ের এক বিজ্ঞানী ও তাঁর স্ত্রী – এডভার্ড ও মাই-ব্রিট মোজার৷
মানুষ যখন পথ খোঁজে, তখন তার মস্তিষ্কে কী ঘটে? মস্তিষ্ক বোঝে কী করে, মস্তিষ্কের অধিকারী আপাতত ঠিক কোথায় আছেন? মনস্তত্ববিদ তথা স্নায়ুবিজ্ঞানী এডভার্ড মোজার সারা জীবন ধরে এ নিয়ে গবেষণা করছেন৷ নরওয়ের বাসিন্দা মোজার ও তাঁর স্ত্রীর গবেষণার বিষয় হলো: মস্তিষ্ক যখন পথ খোঁজে, তখন তাকে কী করতে হয়৷ ২০১৪ সালে চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এডভার্ড মোজার বলেন:
‘‘কাজটা বেশ জটিল, কেননা পারিপার্শ্বিকের সব দিক সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে, সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত পথটি খোঁজার জন্য তো বটেই, আবার এ-ও দেখতে হবে, পথে এমন কোনো বস্তু পড়ছে কিনা, যার জন্য অন্য পথে যেতে হতে পারে৷ অর্থাৎ জটিল সব সিদ্ধান্ত নিতে হবে; এমন বহু জিনিস তুলনা করে দেখতে হবে, যেগুলো ঠিক এই মুহূর্তে হাতের কাছে কিংবা চোখের সামনে নেই৷''
মোজার দম্পতি গবেষণা করে বার করেছেন যে, একটি ইঁদুর যখন বিস্কুটের টুকরো খোঁজে, তখন তার মগজে পারিপার্শ্বিকের একটা মানচিত্র তৈরি হয়৷ এডভার্ড ও তাঁর স্ত্রী মাই-ব্রিট মোজার বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তা প্রমাণ করতে পেরেছেন৷ এ বিষয়ে মাই-ব্রিট বলেন: ‘‘এই ইঁদুরগুলো যদি না থাকত আর তারা যদি আমাদের সাথে সহযোগিতা না করত, তাহলে আমরা কোনো তথ্য পেতাম না৷ সেই কারণেই ইঁদুরগুলোর সঙ্গে খেলা ও তাদের খুশি রাখাটা এত গুরুত্বপূ্র্ণ৷ ওরা খুশি না হলে, ওরা ভালো না থাকলে, ওরা আমাদের কার্যকরি তথ্য দিতে পারবে না৷''
মস্তিষ্কের জিপিএস
মস্তিষ্কে সূক্ষ্ম বিদ্যুতের তার ঢুকিয়ে মোজার দম্পতি ঠিক সেই কোষগুলো খুঁজে পান, যেগুলো সঠিকভাবে নির্দেশ করে, ইঁদুরটি আপাতত কোথায় রয়েছে৷ কোষগুলো যখন কাজ করে, তখন একটা আওয়াজ শোনা যায়৷ কোষগুলোর নেটওয়ার্ক ঠিক জিপিএস-এর মতো কাজ করে৷ মোজার বললেন: ‘‘জিপিএস যেমন একটা গাড়ির অবস্থিতির খেয়াল রাখে, ঠিক সেইভাবে এই কোষগুলো খেয়াল রাখে, মানুষ কিংবা প্রাণীটি কোনদিকে যাচ্ছে, তা সেটা রাস্তাই হোক আর একটা গাছই হোক কিংবা বাড়িই হোক৷ কাজেই দূরত্ব এবং দিক, এ দু'টোই হলো আসল কথা৷''
নোবেল পুরস্কার বিজয়ীরা আবিষ্কার করেছেন যে, ইঁদুরের মগজের সংশ্লিষ্ট কোষগুলি পারিপার্শ্বিককে এক ধরনের গ্রিড হিসেবে ধরে রাখে – সেজন্য মোজার দম্পতি তাদের নাম দিয়েছেন ‘গ্রিড সেল'৷ কোষগুলি একটি মানসিক মানচিত্র তৈরি করে, যা অনুযায়ী ইঁদুরটি চলাফেরা করে৷ মোজাররা এ যাবৎ তাঁদের আবিষ্কৃত গ্রিড সেলগুলিকে শুধু শুনতে পেতেন৷ মিউনিখের নিউরো বায়োলজিস্ট টোবিয়াস বনহ্যোফার আর এক ধাপ এগিয়েছেন৷ মার্টিনসরিড-এর ম্যাক্স-প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর নিউরোবায়োলজি-র টোবিয়াস বনহ্যোফার বলেন: ‘‘মোজাররা স্বভাবতই স্পেসিয়াল পার্সেপশন এবং তথাকথিত গ্রিড সেলের ক্ষেত্রে বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানী – এবং সেজন্য তাঁরা নোবেল পুরস্কারও পেয়েছেন৷ আমরা যেটা যোগ করতে পারি, সেটা হলো ছবি: আমরা কোষগুলোকে দৃষ্টিগোচর করে তুলতে পারি৷''
আলৎসহাইমার হলে প্রথমেই যায় গ্রিড সেল
একটা কালো বাকসো কিংবা বাঁকাচোরা স্ক্রিন – তার মধ্যেই ইঁদুরদের রাস্তা খুঁজে নিতে হবে৷ টোবিয়াস বনহ্যোফারের বিশেষ প্রক্রিয়ায় গ্রিড সেলগুলো ঠিক যখন সক্রিয় হয়, তখনই তারা জোনাকির মতো আলো ছড়ায়৷ আলৎসহাইমার রোগীর ক্ষেত্রে এই সেলগুলি গোড়াতেই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে, বলে গবেষকদের ধারণা – কেননা ডিমেন্সিয়ার রোগী সবার আগে নিজের অবস্থান সম্পর্কে সচেতনতা হারিয়ে ফেলেন৷ কাজেই বিজ্ঞানীরা জানতে চান, গ্রিড সেলগুলি ঠিক কিভাবে কাজ করে এবং কখন তারা কাজ করা বন্ধ করে৷
মস্তিষ্কের জিপিএস আবিষ্কার শুধু একটা সূচনা, বলছেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এডভার্ড মোজার৷ সমগ্র মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে, সেটা তাঁর কাছে আরো বড় আশ্চর্য৷ কাজেই আগামীতে তাঁর কাজের কোনো কমতি নেই৷