‘মধু খেতে আসা বিদেশি ভ্রমরদের সামলাতে পেশাদারিত্ব দরকার’
২৮ মে ২০২১তবে উন্নত বাংলাদেশের মধু খেতে অনেক ভ্রমর আসতে পারে এমনটা উল্লেখ করে তিনি বলেন, পরিস্থিতি সামলাতে সবক্ষেত্রে পেশাদারিত্ব প্রয়োজন৷ তার মতে, বাংলার সম্পদের লোভে আসা ইংরেজরা অষ্ট্রাদশ শতাব্দীতে যে তাদের শাসনের সূচনা করেছিলে, সেই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে৷
তিনি আরো মনে করেন, ওই সময় (পলাশির যুদ্ধের আগে) ইংরেজদের পাশাপাশি অন্য ইউরোপিয়ানরা সমানভাবে এখানে থাকলে ফল ভিন্ন হতে পারতো৷
সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের যে নীতি বাংলাদেশ পররাষ্ট্রনীতিতে প্রয়োগ করে, সেটারও উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ৷
তার মতে, এই নীতির প্রতি বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের অঙ্গীকারের ধারাবাহিকতার কারণে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য নিয়ে দেশ স্বাধীন হলেও দ্রুতই স্নায়ুযুদ্ধকালীন সময়ের অপর শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি পায় বাংলাদেশ৷ জিয়াউর রহমানসহ অন্যরাও পরে এই নীতির কথা বলেছেন৷
ড. ইমতিয়াজ মনে করেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এখন এমন একটা জায়গায় চলে গেছে যে, এখানে বাইরের কারো প্রভাব খুব বেশি কাজে আসছে না৷ বরং বাংলাদেশ প্রায় পুরোটাই নিজেদের মতো করে এটা ঠিক করে৷
পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, এমনকি বাংলাদেশে সরকার বদলে গেলেও পররাষ্ট্রনীতিতে আর খুব বেশি পরিবর্তন হবে না, বলেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ৷
বাংলাদেশের উন্নতির সাথে সাথে দেশটির পররাষ্ট্রনীতির এই মূলনীতিটা মডেল আকারে দাঁড়িয়ে যাবে বলেও মনে করেন তিনি৷ তবে ভবিষ্যতেও এর সুফল পেতে যে পেশাদারিত্ব প্রয়োজন, সে জন্য প্রস্তুতি নেয়া উচিত৷
ডয়চে ভেলের সাথে তার আলাপের চৌম্বক অংশ এখানে তুলে ধরা হলো৷
ডয়চে ভেলে: মুজিবনগর সরকারের বন্ধুরা ছিল একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্নের৷ কিন্তু বাহাত্তর সালেই দেখা যায়, বিপুল সংখ্যক দেশ আমাদেরকে স্বীকৃতি দেয়, এটা কি যুদ্ধচলাকালীন কূটনীতির সাফল্য, নাকি যুদ্ধের পরের?
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ: মনে রাখতে হবে, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই (শুধু) যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে৷ এটা নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মিক্সড রিঅ্যাকশন ছিল৷ অ্যামেরিকা-চীন আমাদের বিরোধিতা করেছে৷ ভারত-রাশিয়ার সাহায্য পেয়েছি৷
যেহেতু তখন স্নায়ুযুদ্ধ ছিল, তাই তখন যে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে থাকে, সে অ্যান্টি-আমেরিকান, যে আমেরিকার সাথে থাকে, সে অ্যান্টি-সোভিয়েত-এ রকম ব্যাপার ছিল৷
সেই জায়গায় স্বীকৃতি পাওয়া কঠিন ছিল৷ কিন্তু বাহাত্তরে ভারতের সৈন্যরা চলে গেলে একাধিক ইউরোপীয় দেশ থেকে স্বীকৃতি আসে৷ সেখানে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব ও স্বীকৃতি এবং ডিপ্লোম্যাসি কাজে দিয়েছে৷
সোভিয়েত ইউনিয়ন স্বাধীনতার পক্ষে থাকলেও যুদ্ধের পর অ্যামেরিকা আমাদেরকে স্বীকৃতি দিয়েছিল৷ আমরা কি পররাষ্ট্রনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন করেছিলাম?
না, ওই প্রিন্সিপলটা কাজে দিয়েছে৷ মনে রাখতে হবে, সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের প্রিন্সিপলটা, সেটা কিন্তু আগে থেকেই তৈরি করা৷ ৭০-এর নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের ইশতেহারে তা ছিল৷
যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীনতার পর স্বীকৃতি দেয়ার পরও ‘বটমলেস বাস্কেট’ বলেছে বা (৭৪-এর দুর্ভিক্ষের আগে) খাদ্যের জাহাজ পাঠানোর কথা, কিন্তু পাঠায়নি৷ তারা এ রকম নানামুখী আচরন কেন করেছে?
স্নায়ুযুদ্ধ যেহেতু ছিল, যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন পুরোপুরি আমাদের পক্ষে ছিল৷ যেহেতু তখনকার আমলে আমরা সোভিয়েত ব্লকে চলে গেলাম৷ বটমলেস বাস্কেট কিন্তু স্বাধীনতার আগে বলা৷ বলেছে অন্য একজন৷ পরে এটা কিসিঞ্জারের নামে প্রচারিত হয়৷
যে কারণে দুর্ভিক্ষ হলো, আমরা কিউবাতে পাট পাঠিয়েছিলাম৷ তারা (যুক্তরাষ্ট্র) হয়ত মনে করেছিল, দুর্ভিক্ষ হলে আমরা আরো বেশি করে পশ্চিমাদের দিকে ঝুঁকবো৷
বঙ্গবন্ধু যেহেতু খোলাখুলিভাবে ভিয়েতনামের পক্ষে, কিউবার পক্ষে যাচ্ছিলেন, কিসিঞ্জার, নিক্সন হয়ত মনে করলেন, ‘‘আমি বাংলাদেশকে কেন উপকার করবো৷’’ নিক্সন, কিসিঞ্জারের সরকারে যারা ছিল, তাদের সঙ্গে বন্ধবন্ধুর চিন্তা ছিল কিন্তু একেবারেই বিপরীত৷
মুক্তিযুদ্ধের সময় অধিকাংশ মুসলিম দেশ আমাদের বিরোধিতা করেছিল৷ কিন্তু এরপরও বঙ্গবন্ধু ওআইসি সম্মেলনে গেলেন এবং সেটাও আবার পাকিস্তানে৷ কেন তাকে এটা করতে হয়েছিল?
আরবদের বিরোধিতার কারণ, পাকিস্তান তাদেরকে বলতো, এই দেশটি ভারত হয়ে যাবে৷ আর আরব দেশগুলো ছিল মূলত অ্যামেরিকার পকেটে৷ এটাও মনে রাখতে হবে৷ কিন্তু স্বাধীনতার পর দ্বিতীয় বৃহত্তম এই মুসলিম রাষ্ট্রকে ওআইসির বাইরে রাখা তো হাস্যকর৷ তখন, বিশেষ করে আলজেরিয়া ও ফিলিস্তিনের ইয়াসির আারাফাত উদ্যোগ নেন৷ তখন বঙ্গবন্ধু শর্ত দেন,পাকিস্তানের স্বীকৃতি না পেলে কেবল সম্মেলনের জন্য তিনি লাহোরে যাবেন না৷ সেই সম্মেলন মৌলিকভাবে অনেক কিছুকে পরিবর্তন করে দেয়৷ জাতিসংঘের সদস্য পদ পাওয়ার পথও এর মাধ্যমে বাধামুক্ত হয়েছে৷
বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতের পর গড়ে উঠে চীনের সাথে সম্পর্ক৷ এরপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে ভারতপন্থি আর অন্য কেউ থাকলে চীনপন্থি পররাষ্ট্রনীতির একটা ধারণা গড়ে উঠে৷ এটা কি এখনো আছে?
চীনের প্রতি বঙ্গবন্ধুর একটা সফট কর্নার সব সময় ছিল৷ তাদের স্বীকৃতি প্রক্রিয়াটা তিনিই শুরু করেন৷ সেখানে একটি সিক্রেট ডেলিগেশনও পাঠিয়েছিলেন৷ বাংলাদেশের ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’ হওয়ার বিষয়টা চীনকে দেখেই হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন৷ তাই হয়ত চীনের স্বীকৃতির বিষয়টা বাই প্ল্যানে এমনিতেই (বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলেও) আসতো৷
বাংলাদেশে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে অনেক কিছুতে ঐক্যমত থাকে না৷ কিন্তু কিছু কিছু বিষয়ে আছে৷ যেমন: ওয়েলফেয়ারে কিছু পার্থক্য থাকলেও ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি হওয়ার বিষয়টাতে ঐক্যমত আছে৷ ২০২১ সালে এসে বলা যায়, চীনের বিষয়েও আমাদের একটা জেনারেল ঐক্যমত হয়ে গেছে৷
আমরা কি এখন চীন-ভারতের মধ্যে ব্যালান্স করছি? এটা কি ভবিষ্যতে কোনো ঝুঁকি তৈরি করবে?
আমরা ব্যালান্স করছি না৷ আজ এখানে কাল সেখানে করছি না৷ পদ্মা সেতু বা তিস্তা প্রকল্প-সহযোগিতা কে দেবে? চীন৷ অন্য কারো সেই সামর্থ নেই৷ আমাদের পলিসি এলিটরা পশ্চিমামুখি হলেও ভ্যাক্সিনের ব্যাপারে এখন আমাদেরকে চীনের কাছেই যেতে হয়েছে৷ সেটা প্রয়োজনে৷
তার মানে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি কি নিজেদের স্বার্থেই হয়?
যেহেতু এখন বাংলাদেশ কারো উপর অতখানি নির্ভরশীল না, সেই জায়গায় কিছুটা বডি ল্যাঙ্গুয়েজ পরিবর্তন হওয়ার কথা৷ সেটা এখন হয়েছে৷ আগে যে অবস্থা ছিল, সেটা এখন নেই৷ এখানকার অ্যাম্বাসিরা আগে যেভাবে কথা বলতো, এখন সেটা বলতে পারছে না৷
বাংলাদেশ শক্তিশালী হলে সবাই কি বাংলাদেশকে আরো বেশি করে নিজেদের পক্ষে পেতে চাইবে না?
হ্যাঁ, এটা গুরুত্বপূর্ণ৷ তুর্কি কবির বিখ্যাত একটা কথা আছে যে, আমার পটে যদি মধু থাকে, তাহলে বিভিন্ন জায়গা থেকে ভ্রমর আসবে৷ ওই শিক্ষা আমরা পেয়েছি৷
ঢাকা যে শহর আমরা এখন দেখি, এই ঢাকা অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিশাল সিটি ছিল এবং একটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিটি ছিল৷ এই যে কটন প্রোডাকশন এখন হয়, এটা তখনই ছিল৷ নামকরা, ওই আমলে৷ বিশেষ করে যদি আমরা মসলিনের কথা বলি৷ আমরা তো জানি, মধু থাকলে ভ্রমররা আসবে৷ আর হ্যাঁ, ভবিষ্যতে মধু যদি আরো বাড়ে, তাহলে ভ্রমর আরো আসবে চতুর্দিকে৷ তবে যেহেতু আমরা চালাক হয়েছি, তাই সব ধরনের ভ্রমরের জন্য আমরা দরজা-জানালা খুলেছি৷ কোনো একটা ভ্রমরের জন্য না৷ উল্টাটা তখন করা হয়েছিল৷ তখন যদি আমরা ফেঞ্চ-পর্তুগিজ সবাইকে বলতাম, তোমরা আসো৷ তাহলে হয়ত আমরা বেঁচে যেতাম৷ ওই জায়গায় আমাদের প্রচণ্ডভাবে স্মার্ট হতে হবে৷
ভবিষ্যতে সরকার পরিবর্তন হলেও কি আমাদের বৈদেশিক নীতি একই রকম থাকবে?
ট্রেডের ফিগার যদি দেখি, বিএনপির সময়ও আমাদের ভারতের সাথে সম্পর্ক ভালো ছিল৷ রৌমারির যে ইনসিডেন্ট হয়েছিল, সেটা কিন্তু আওয়ামী লীগের সময়ে৷ বিএনপির সময়ে না৷
রেটোরিক অবশ্য ভিন্ন৷ সেটা কেবল আমাদের এখানে না৷ অ্যামেরিকায় ট্রাম্প, পশ্চিমবাংলায় অমিত শাহ৷ এগুলো ভোট পাওয়ার জন্য রেটোরিক করে৷ বাংলাদেশে যে-ই ক্ষমতায় আসবে, তাকে যেহেতু বাংলাদেশের উন্নয়নে নজর রাখতে হবে, তাই খুব বেশি এদিক-সেদিক করার উপায় নেই৷ নয়ত সে কয়দিন ক্ষমতায় থাকবে?
তার মানে আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে প্রভাবশালীদের কোনো প্রভাবই থাকে না?
বলতে গেলে কমে এসেছে৷ একেবারেই রাখতে পারে না, সেটা হয়ত বলা ভুল হবে৷ তবে কমে এসেছে৷ আগে যেটা রাখতে পারতো, কারণ এইডের পরিমাণ অনেক বড় ছিল৷ বলে না যে, মানি টকস৷ তখন বাংলাদেশ সরকারকে বারবার তাদের কাছে যেতে হতো৷ তারা তখন স্বাভাবিকভাবে শর্ত দিতো- এটা করো, ওটা করো৷ তারা বড় আকারে বিভিন্ন এনজিওকে টাকা দিতো, সিভিল সোসাইটিকে দিতো৷ তারাও তখন সোচ্চার হতো৷ কিন্তু এখন তাদের পয়সা কমে এসেছে৷ চীন হলো এমন একটা রাষ্ট্র যে এ সব বিষয়ে মাথা ঘামায় না৷ কোন পত্রিকায় কী লিখলো, কাকে মন্ত্রী করতে হবে, নির্বাচন হলো কি হলো না-এগুলোতে মাথা ঘামায় না, যতদিন তার ইনভেস্টমেন্টের রিটার্ন পাচ্ছে৷
তার মানে কাকে মন্ত্রী বানাতে হবে-এটা পশ্চিমা দুনিয়া বলে দিতো?
তারা খোলাখুলিভাবে মিটিং করতো৷ ব্রেকফাস্ট মিটিং করতো৷
আমাদের একটা রাজনৈতিক লক্ষ্য আছে, ২০৪১ সালে আমরা উন্নত বাংলাদেশ হবো৷ সেই উন্নত দেশের পররাষ্ট্রনীতি কেমন হবে, সেই জন্য আমাদের কী ধরনের প্রস্তুতি নেয়া উচিত?
দক্ষিণ এশিয়ার প্রসঙ্গ আসলেই এখন ইন্দো-পাকিস্তান৷ এটা যাতে ইন্দো-পাকিস্তান-বাংলাদেশ বলে৷ সবার সাথে বন্ধুত্ব রাখার মডেলটা আরো বেশি রেপ্লিকেট হবে৷
প্রস্তুতির দরকার আছে কি-না, সেটা জিজ্ঞেস করেছি স্যার…
যে মডেলটা তৈরি হয়েছে, সেটা ধরে রাখার জন্য আমাদের প্রচণ্ড পেশাদারিত্ব দরকার৷ মিডিয়া, অ্যাকাডেমিক, ব্যুরোক্রেসি-সবার পেশাদারিত্ব দরকার৷ আমাদের অনেক মেধা পশ্চিমা দেশে চলে যায়৷ তারা সেখানে সার্ভ করে৷ এটা পরিবর্তন করা দরকার৷
মেধা সব চলে গেলে একটা মিডিওকার সোসাইটি তৈরি হবে৷ তখন বড় কোনোা ঘটনা ঘটলে সামাল দিতে পারবে না৷
যত বেশি উন্নয়ন হবে, শত্রু কিন্তু বাড়বে৷ তাই আমাদের পেশাদারিত্ব বাড়াতে হবে৷ কেবল সামরিক বাহিনীর পেশাদারিত্ব না৷ সবক্ষেত্রে৷ ট্রাফিক পুলিশের পেশাদারিত্ব থেকে শুরু করে, অফিস ক্লার্কের পেশাদারিত্ব থেকে শুরু করে সবখানে পেশাদারিত্ব ঠিক করতে হবে৷ বড় চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে৷ সেই চ্যালেঞ্জ যত তাড়াতাড়ি আমরা সামাল দিতে পারবো, ততই মঙ্গল৷