‘কাতার সংকট’এ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বাংলাদেশ
১২ জুন ২০১৭সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)-র ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান ডয়েচে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক সংকট যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে তা বাংলাদেশের জন্য শঙ্কার কারণ হবে৷’’
বিদেশে বাংলাদেশি কর্মীদের বড় অংশটিই থাকে মধ্যপ্রাচ্যে৷ তাঁদের অধিকাংশই জড়িত নির্মাণখাতের সঙ্গে৷ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক সংকট আরো ঘনীভূত হলে তা দেশগুলোতে অর্থনৈতিক সংকটও তৈরি করতে পারে৷ শ্লথ হয়ে পড়তে পারে উন্নয়ন কাজ, যা শ্রমিক মজুরি বা নতুন নিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে৷ ফলে ঝুঁকিতে পড়তে পারে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ৷
ড. মুস্তাফিজের মতে, এমনিতেই ইনফর্মাল উপায়ে অর্থ পাঠানোর কারণে রেমিটেন্সের অর্থনৈতিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার, তার ওপর এই সংকট গভীরতর হতে থাকলে তা ভাববার কারণ হবে৷
‘‘গেল দুই বছরে ১৩ লাখের ওপরে মানুষ বাইরে গিয়েছেন এবং তার মধ্যে দুই তৃতীয়াংশই মধ্যপ্রাচ্যে গিয়েছেন৷ যেহেতু আমাদের ২২০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে ১৫ বিলিয়ন ডলার আসে রেমিটেন্স থেকে, সেখানে এ বছর প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলারের মতো কম আসবে৷ এর প্রধান কারণ হুন্ডি ও ইনফর্মাল উপায়ে টাকা পাঠানো৷ আরেকটি কারণ, মধ্যপ্রাচ্যে তেলের দাম কমে যাওয়ায় অনেক কোম্পানিতে বেতন বা খরচ কমানোর একটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে৷’’
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের একটি রিপোর্টে দেখা গেছে, কাতার ইস্যুতে মধ্যপ্রাচ্য সংকটে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ কয়েক বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে৷ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরবে আছে প্রায় ২৫ লাখ বাংলাদেশি৷ আরব আমিরাতে আছে প্রায় ৭ লাখ৷ আর কাতারে এখন প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা ৩ লাখ ৮০ হাজার৷ গত বছরেও মোট জনশক্তি রপ্তানির ২২ শতাংশের বেশি হয়েছে কাতারের শ্রমবাজারে৷ দেশটিতে ২০২২ বিশ্বকাপ উপলক্ষে আরো অনেক জনশক্তি রপ্তানির সুযোগ আছে বাংলাদেশের৷
জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার সভাপতি বেনজির আহমেদও মধ্যপ্রাচ্যে চলমান সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে বাংলাদেশের শ্রম বাণিজ্য ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা করছেন৷ ডয়েচে ভেলেকে তিনি জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত কোনো নেতিবাচক প্রভাব তৈরি হয়নি৷ কিন্তু ভবিষ্যতে হবে না তার নিশ্চয়তা নেই৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা মনে করি, সরকারও মনে করে এখনো কোনো সমস্যা তৈরি হয়নি৷ তবে ২০২২ সালের বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবে৷ সেজন্য কাতারে প্রচুর কর্মী দরকার৷ কিন্তু কর্মী নেয়া সেভাবে গতি পাচ্ছে না৷ এর মাঝখানে সৌদি আরব ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে কাতারের কূটনৈতিক সম্পর্ক বন্ধ হয়ে গেছে৷ নৌ, সড়ক ও আকাশপথ বন্ধ হয়ে গেছে৷ কাতারে প্রবেশ করাটাই এখন কঠিন হয়ে গেছে৷’’ তবে কাতারের অর্থনীতি চলমান ধাক্কাটি সামলে নিতে পারলে সমস্যা হওয়ার কথা নয় বলে মনে করেন তিনি৷
কাতারে প্রবাসী বাংলাদেশিদেরও একই আশা৷ পাঁচ বছর ধরে সেখানে আছেন ব্যাংকার তাইজুল ইসলাম৷ ডয়েচে ভেলেকে তিনি জানিয়েছেন, কারো কারো মধ্যে আতঙ্ক আছে৷ কিন্তু ওসবে কান না দেয়াই ভালো৷ ‘‘কাতারে দুবাই ও সৌদি আরবের মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো বন্ধ হয়ে গেলে কিছুটা সংকট তৈরি হতে পারে৷ কিন্তু সেক্ষেত্রেও যদি কোম্পানিগুলোর কাতারের অংশীদাররা সৌদি ও দুবাইয়ের শেয়ারগুলো কিনে নেন, তাহলে অত সমস্যা হবার কথা না-'' বলছিলেন তাইজুল৷ কাতার প্রবাসী এই বাংলাদেশি আরও বলেন, ‘‘আমার সঙ্গে যাদের কথা হয়, তাদের বলি এসব গুজব থেকে দূরে থাকবেন৷’’
সিপিডির ড. মুস্তাফিজের মতে, ‘‘শুধু শ্রমবাজারই নয়, কাতারের সঙ্গে বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক সম্পর্কও বাড়ার সুযোগ আছে৷ তাদের কাছ থেকে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস-এলএনজি আমদানির কথা রয়েছে৷ অন্যদিকে, সৌদি আরব ও আমিরাত যেহেতু বাংলাদেশের শ্রমশক্তির বড় বাজার এবং সৌদি নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসবিরোধী জোটেও আছে বাংলাদেশ, তাই কূটনৈতিকভাবেও বাংলাদেশকে রয়ে-সয়ে এগুতে হবে৷ কারো সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট যেন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে৷’’
বলা হয়ে থাকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের পররাষ্ট্রনীতি হলো, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরীতা নয়৷ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির পরিষ্কার মেরুকরণের মাঝে কাতারের বিষয়েও সেই পররাষ্ট্রনীতি ধরে রাখতে পারলেই আখেরে লাভবান হবে বাংলাদেশ– এমনটাই মত বিশ্লেষকদের৷
প্রিয় পাঠক, আপনি কিছু বলতে চাইলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে...