‘মন বান্ধিবি কেমনে’
১৬ জুন ২০২০৭৮ বছর ধরে মূলত যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের শ্রোতা-দর্শকদের জন্য ৪৭টি ভাষায় খবর ও অনুষ্ঠান প্রচার করে আসছে ভয়েস অব অ্যামেরিকা৷ আগে ছিল শুধু রেডিও আর টেলিভিশন, তবে কয়েক বছর হলো অনলাইনেও এসেছে৷ যুক্তরাষ্ট্র সরকারের টাকায় চলে বলে ঘোষণা দিয়ে মোটামুটি সরকারের সঙ্গে তাল মিলিয়েই চলে তারা৷ অনেক সময় মনে হয়, খবরগুলো যেন সরকারের পররাষ্ট্রনীতির পরোক্ষ কপি-পেস্ট৷
পরিচালক অ্যামান্ডা বেনেট আর সহকারী পরিচালক স্যান্ডি সুগাওয়ারা কপি-পেস্টটা সাংবাদিকতাকে একেবারে জলাঞ্জলি দিয়ে করতে চাননি বলেই চাকরিটাও বাঁচাতে পারলেন না৷ অবশ্য চাকরি বাঁচানোর চেষ্টাও তারা করেননি৷ সে চেষ্টা করলে অনেক আগেই হয়ত ট্রাম্প এবং তার প্রশাসনের সুরে সুর মেলাতেন৷
বিপত্তি বাধিয়েছে আসলে করোনা ভাইরাস৷ ট্রাম্প শুরু থেকেই চীনকে যতটা পাত্তা দিচ্ছেন, করোনাকে ততটা দিচ্ছেন না৷করোনা সংকটেও চীনের বিরুদ্ধে যতটা ‘তোপ’ দাগাচ্ছেন, করোনার বিরুদ্ধে তার সিকিভাগও দাগাচ্ছেন না৷ তাতে লাভ হয়েছে কার? ক্ষতিই বা কার হয়েছে?
ক্ষতি যে চীনের হয়নি তা খুব স্পষ্ট৷ করোনা সংকট প্রায় সামলে নিয়েছে চীন৷ অন্য দিকে প্রথমে প্রতিরোধের কোনো উদ্যোগ না নিয়ে সারা দেশে সংক্রমণ ছড়াতে দিয়েছেন ট্রাম্প, ফলে এক জন দুই জন করে মরতে মরতে ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের এক লাখ ১৮ হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণ কেড়েছে করোনা৷
করোনার খবরে চীন আর যুক্তরাষ্ট্রের এত বড় পার্থক্যটাই একটু স্পষ্ট করে তুলছিল ভয়েস অব অ্যামেরিকা৷ চীনের মতো দেশের খবর তো বাদ দেয়া যায় না, বেনেট আর সুগাওয়ারাও চাননি সাংবাদিকতার ন্যূনতম দাবি ভুলে সেসব বাদ দিতে৷ ফলে করোনার বিরুদ্ধে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতিটি পদক্ষেপ ও সংক্রমিত এবং মৃতের সংখ্যার পাশেই থাকছিল চীনের খবর৷ খুল্লাম খুল্লা হয়ে যাচ্ছিল তফাৎটা৷ সে কারণে ট্রাম্প এবং তার সমর্থকদের মাঝে বাড়ছিল অসন্তোষ৷ তারই পরিণাম ভয়েস অব অ্যামেরিকার পরিচালক অ্যামান্ডা বেনেট এবং সহকারি পরিচালক স্যান্ডি সুগাওয়ারার পদত্যাগ৷
কী ‘অপরাধ’ তাদের?
করোনা ভাইরাসের প্রাদূর্ভাব প্রথম দেখা দিয়েছিল চীনের উহান শহরে৷ সেখানে করোনা এখন নিয়ন্ত্রণে, শুরু হয়েছে লকডাউন তুলে নেয়ার প্রক্রিয়া, স্বাভাবিক ছন্দ ফিরছে জনজীবনে- এসব তথ্য নিয়ে একটা প্রতিবেদন করেছিল বার্তা সংস্তা এপি৷ অ্যামান্ডা বেনেট এবং স্যান্ডি সুগাওয়ারার ভয়েস অব অ্যামেরিকা শুধু সেই খবরটা প্রচার করেছিল৷ তাতেই একেবারে অশুদ্ধ হয়ে যায় মহাভারতের ট্রাম্প-ভার্শন৷
শুরু হয়ে যায় ভয়েস অব অ্যামেরিকার পরিচালক এবং সহকারি পরিচালকের বিরুদ্ধে বিষোদগার৷ তবে এবার যে বিষয়টি শুধু হুমকি-ধমকিতে থেমে থাকবে না তার ইঙ্গিত ছিল হোয়াইট হাউসের এক কর্মকর্তার বক্তব্যে৷ ভয়েস অব অ্যামেরিকার বিরুদ্ধে করদাতাদের টাকায় ‘‘(চীনের) স্বৈরাচারী সরকারে পক্ষে প্রচার’’ চালানোর অভিযোগ তুলেছিলেন তিনি৷ তাতেও দমে যাননি ওই দুই নারী৷ রাষ্ট্রযন্ত্রের চোখ রাঙানিতে ভুলে যাননি সাংবাদিকের দায়িত্ব৷ অনুসন্থানী প্রতিবেদনের জন্য পুলিৎজার পুরস্কার জয়ী অ্যামান্ডা বেনেট চাপের মুখেও মাথা নত না করে দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে গত চার বছরে যেসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন তার একটা বিবরণ তুলে ধরেছিলেন৷ আর খুব স্পষ্ট করে বলেছিলেন, ‘‘ভয়েস অব অ্যামেরিকার মতো জনগণের টাকায় চলা একটি স্বাধীন সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যমের বড় একটা পার্থক্য হলো, আমরা যে-কোনো বিষয়ে সব দিকের তথ্য মুক্তভাবে তুলে ধরতে পারি৷ভয়েস অব অ্যামেরিকার নীতিমালায় উল্লেখ করা আইনও এ অধিকার দিয়েছে আমাদের৷’’
নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন৷ তার আগে ভয়েস অব অ্যামেরিকাকে ‘বাগে আনতে’ স্পষ্টতই মুখিয়ে ছিলেন ডনাল্ড ট্রাম্প৷ চট চলদি মাইকেল প্যাককে পরিচালক বানিয়ে সেই পথে জোর কদমে হাঁটতে শুরু করেছেন তিনি৷
পদত্যাগের আগে বা পরে ট্রাম্পের এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে একটা কথাও বলেননি অ্যামান্ডা বেনেট এবং স্যান্ডি সুগুওয়ারা৷ যা বলার তো আগেই বলেছেন৷ আর যে যা বলেননি তা বলা হয়েছে এক বাংলা লোকগানে,
‘‘আমার হাত বান্ধিবি, পা বান্ধিবি
মন বান্ধিবি কেমনে,
আমার চোখ বান্ধিবি, মুখ বান্ধিবি
পরাণ বান্ধিবি কেমনে৷৷’’
‘পোষ না মানা’ মানুষের প্রতিবাদ চলেছে, চলবে৷ হাত-পা, মুখ-চোখ বেঁধে দিলেও চলবে৷
২০১৮ সালের নভেম্বরের ছবিঘরটি দেখুন...