মসনদে যেতে সচেষ্ট 'শাহজাদা', শেষরক্ষা হবে কি?
২৬ আগস্ট ২০১৮‘শাহজাদা' জার্মানিতে আসছেন খবর পেয়েই সিদ্ধান্ত নেই ডয়চে ভেলের জন্য একটা সাক্ষাৎকার নেবো৷ রাহুলের হামবুর্গের ব্রুসিরাস সামার স্কুলে আর বার্লিনে ইন্ডিয়ান ওভারসিজ কংগ্রেসের একটি অনুষ্ঠানে ভাষণ দেয়ার কথা ছিল৷ সেইমতো ওভারসিজ কংগ্রেসের মুখপাত্র হরদীপ সিং এবং রাভিনদর সিং-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম৷
কথা ছিল, বার্লিনে আসার পর, অর্থাৎ ২৩ আগস্ট সকালে, ডয়চে ভেলেকে একটি একান্ত সাক্ষাৎকার দেবেন রাহুল৷ ইন্টারভিউটা হবে সোনিয়া তনয় যেখানে উঠবেন, অর্থাৎ আডলন হোটেলেই৷ সঙ্গে সঙ্গে হোটেলের গ্রন্থাগার ‘বুক' করা হলো৷ বই-পত্রের মাঝেই ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের বর্তমান সভাপতির সাক্ষাৎকার নেবো আমি৷ দু'জন ক্যামেরাপারসন, হিন্দি ও উর্দু বিভাগ থেকে ওঙ্কার আর আদনান, সঙ্গে আমি - সবাই তৈরি৷ কিন্তু বিমান ছাড়ার মাত্র তিন ঘণ্টা আগে খবর পেলাম – শুধু ডয়চে ভেলে নয়, কোনো টেলিভিশন চ্যানেলের সঙ্গেই নাকি কথা বলবেন না রাহুল৷ তাহলে?
রাজীবের ছেলে, ইন্দিরা গান্ধীর নাতি এত কাছ থেকে চলে যাবেন, একবার দেখবও না? তাও আবার হয় নাকি? অগত্যা ক্যামেরাপারসন, ওঙ্কার-আদনানকে ছাড়াই রওনা দিলাম রাজধানীর পথে৷
সে যাই হোক, ইন্টারভিউ পাবো না বলে মেজাজটা ভালো ছিল না৷ কিন্তু ১৯৮৪ সালের ৩১শে অক্টোবরের কথা মনে পড়ে গেল, হঠাৎই...৷
সেদিন কলকাতা শহরে প্রায় রায়ট লাগে লাগে অবস্থা৷ ইন্দিরা গান্ধী নিহত – এ খবর চাউর হওয়ার পর পরই আমাদের স্কুল ছুটি হয়ে যায়৷ কোনোরকমে বাড়ি ফিরে দেখি, মা অঝোরে কাঁদছে৷ কিন্তু কেন? বাংলাদেশে আমার নানা বাড়ির লোকেরা বরাবরই কংগ্রেসকে সমর্থন করতেন আর বাবার দিকের সবাই ছিলেন বামপন্থি আদর্শে উদ্বুদ্ধ৷ তাই শ্বশুড়বাড়িতে একরকম একাই হয়ে গিয়েছিলেন মা৷ তাই বলে এত কান্না? ইন্দিরা গান্ধী তো আমাদের কেউ হন না!
তখন বুঝিনি৷ এ ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যে মায়ের প্যারালাইসিস হয়ে যায়, তারপর কয়েক বছর পর মৃত্যু৷ তাই কারণটা জিজ্ঞাসাও করা হয়নি কখনও৷ তবে এখন মনে হয় মা হয়ত কোনো এক অশনিসংকেত পেয়েছিলেন তখনই৷ ইন্দিরার পর রাজীবের মৃত্যু, কংগ্রেসের মধ্যে ভাঙন, বাবরি মসজিদকে ঘিরে উত্তেজনা, গোধরা, বিজেপির ক্ষমতায় আসা, উন্নয়ন থেকে দলিত, আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের দূরে রাখা – সবটাই তো আমাদের সামনে ঘটেছে৷
অথচ সংখ্যাগরিষ্ঠের তোপের মুখে এককালীন ক্ষমতাধর কংগ্রেসরা বিশেষ কিছু করতে পারেনি৷ দীর্ঘদিন যাবৎ রাহুলের সমালোচনাও তো কম ছিল না – রাজনীতিতে অপরিপক্ক, ‘পাপ্পু' কত না নাম ছিল তাঁর৷ মোদীর ‘ক্যারিসমা'-র সামনে বার বারই প্রশ্ন উঠছিল রাহুলের গ্রহণযোগ্যতাকে ঘিরে৷ তার ওপর রাজনৈতিক ক্ষমতা যে সরকারের হাতে থাকে, তার বিরোধিতা করাই ছিল রাহুলদের মূল কাজ৷
সত্যিই তো, ভারতে একের পর এক নারী ধর্ষণ, ধর্মের নামে বাড়তে থাকা গণপিটুনি, প্রবল বেকারত্ব, জিএসটির ফলে ক্ষুদ্র ও মধ্যম শ্রেণির ব্যবসায়ীদের দুরবস্থা, বিমুদ্রাকরণ, দুর্নীতি – এত কিছুর পরও দেশে এখনও বিজেপির রমরমা৷ ‘শাহ' নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করতে করতে নিয়ে গেছেন সাধারণের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে৷ আজও তাদের হাতে ভারতের প্রায় ১৯টি রাজ্য৷ তাই আগামী নির্বাচনে জিততে না পারলে সংঘ পরিবারের 'হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান'-এর স্বপ্নপূরণ হতে আর দেরি নেই৷ তাই জোটসঙ্গীদের সঙ্গে নিয়ে কংগ্রেস, থুড়ি ‘শাহজাদা' নিজে এসে দেশের হাল না ধরতে পারলে বিপদ আসছে বৈকি! তাঁর এই জার্মানি সফরও যে মসনদে যাওয়ার লক্ষ্যেই৷
কিন্তু শুধু বর্তমান সরকারের বিরোধীতা করলেই যে নির্বাচনে জেতা যায় না – সেটা বোধ হয় হালে বুঝতে পেরেছিলেন রাহুল৷ তাই দেশের হতাশাগ্রস্ত যুবক, কৃষক, সাধারণ মানুষকে শান্তি, অহিংসা ও ভ্রাতৃত্বের পথে নিয়ে যাওয়ার কথা বললেন তিনি জার্মানিতে৷ অবশ্য বার্লিনে আসার আগেই হামবুর্গের ব্রুসিরাস সামার স্কুলে দেয়া রাহুলের বক্তব্যকে কটাক্ষ করে বিজেপি৷ হবে না? রাহুল যে বলেছিলেন, বেকারত্বের কারণে অল্প বয়সি ভারতীয়রা জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস-এ যোগ দিচ্ছে৷ বলেছিলেন ভারতে নারীদের একটা বড় অংশ অরক্ষিত, এ কথাও৷
তাঁর বক্তব্যের সমালোচনা যা-ই হোক না কেন, রহুলকে সরাসরি একটা প্রশ্ন করার লোভ সামলাতে পারলাম না৷ ইন্ডিয়ান ওভারসিজ কংগ্রেসের অধিবেশনে একেবারে প্রথম সারিতে বসার সুযোগও পেয়ে গেলাম৷ এমনকি দর্শকের আসন থেকে প্রথম প্রশ্নটাও করলাম আমি৷ বললাম, ‘‘তরুণ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করা, নারীর ক্ষমতায়ন, সাধারণের জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন, হিন্দুত্ববাদের আগ্রাসন রোধ করা - জোটসঙ্গীর সাহায্য না পেলে এ সব কীভাবে করবেন আপনি? শুধু বিজেপি আর আরএসএস-এর বিরোধীতা করে তো হবে না, তাই না?''
রাহুল বললেন, ‘‘কংগ্রেস শুধু মুসলমানদের নয়, হিন্দু-বৌদ্ধ-শিখ-খ্রিষ্টান সকলের জন্য৷ আমার বিশ্বাস, ভারতের সমস্ত নাগরিকদের মধ্যে কংগ্রেসের মতাদর্শ, কংগ্রেসের বীজ লুকিয়ে আছে৷ আমাদের কাজ হবে, তাদের কাছে টেনে আনা৷''
চীনের সঙ্গে ভারতের তুলনা করে তিনি বললেন, ‘‘প্রতি ২৪ ঘণ্টায় প্রায় ৫০ হাজার তরুণের কর্মসংস্থানের সুযোগ দিচ্ছে চীন৷ অথচ ভারতে ২৪ ঘণ্টায় মাত্র ৪৫০ জন তরুণকে চাকরির সন্ধান দিতে সক্ষম হচ্ছে সরকার৷ তাঁরা একদিকে লম্বা লম্বা ভাষণ দিচ্ছে, অন্যদিকে তরুণ সম্প্রদায় তলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে আর আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন আমাদের চাষি ভাইয়েরা৷''
বললেন আরো কত কিছু...৷ বললেন ঘৃণা নয়, ভালোবাসার কথা, বিভেদ নয়, মৈত্রীর কথা৷ বললেন গণতান্ত্রিক এক সমাজ, সত্যিকারের গণতন্ত্রায়ন, সংগঠনকে শক্তিশালী ও বিস্তৃত করার কথা৷ এমনকি আগামী নির্বাচনে কংগ্রেস-জোটই জিতবে – এমন স্বপ্নের কথাও দৃঢ়কণ্ঠে বললেন রাহুল৷ বললেন, ''বিজেপি একটা সংগঠনের কণ্ঠস্বর, কিন্তু কংগ্রেস গোটা দেশের কণ্ঠস্বর৷''
এ সব কথা বলে তিনি কি শেষ পর্যন্ত মসনদ পাবেন? যে সংগঠনের প্রবাসী কর্মীরা একটা সাক্ষাৎকার আয়োজন করতে পারে না, দলের সভাপতির উপস্থিতিতেও শুরু হয়ে যায় সমর্থকদের চিৎকার-মারামারি, তারা কি আরএসএস-বিজেপিকে মোকাবিলা করতে পারবে? জিততে পারবে ভোট-যুদ্ধ? জানি না, সেটা ভোটের ফলাফল আর তার সঙ্গে যুক্ত রাজনীতি বলবে৷
কিন্তু রাহুলের আকুতি, তাঁর কণ্ঠস্বর, সংবাদমাধ্যমগুলির সাহায্য ছাড়া হিন্দুত্বের দৌরাত্ম্যে বধির হয়ে থাকা ভারতের আপামর জনসাধারণ শুনতে পারবে তো?
লেখাটি সম্পর্কে আপনাদের মতামত জানতে চাই আমরা৷ তাই লিখুন নীচের ঘরে৷