মাওলানা সা'দকে দূরে রেখেই বিশ্ব ইজতেমা
১১ জানুয়ারি ২০১৮তাবলিগ জামায়াত হলো সারাবিশ্বে মুসলামানদের মধ্যে ইসলামের দাওয়াতি কাজের একটি প্রাচীন সংগঠন৷ এর প্রতিষ্ঠাতা ভারতের প্রয়াত মাওলানা ইলিয়াস আহমেদ৷ তিনি ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসার আদর্শের অনুসারী ছিলেন৷ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অদূরে টঙ্গির তুরাগ নদের তীরে প্রতি বছর তাদের বাৎসরিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়, যা বিশ্ব ইজতেমা নামে পরিচিত৷ এই ইজতেমায় বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তাবলিগের মুসল্লিরা অংশ নেন৷
গত ২০ বছর ধরে ভারতের মাওলানা সা'দ কান্ধলভিসহ তিনজন শীর্ষ নেতা যৌথভাবে তাবলিগ জামায়াতের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন৷ একক কোনো নেতৃত্ব নেই৷ গত বছর থেকে বাংলাদেশের হেফাজতে ইসলাম ও কওমী মাদ্রাসাপন্থিরা মাওলানা সা'দ-এর ইজতেমায় আসার বিরোধিতা করে আসছেন৷ এবার তার চরম প্রকাশ ঘটে৷ বুধবার তারা তার আসা ঠেকাতে ঢাকার বিমানবন্দর এলাকা অবরোধ করে৷ সা'দ পুলিশ পাহারায় দুপুরের পর বিমান বন্দর থেকে কাকরাইল মসজিদে যান৷ পুলিশ তার নিরাপত্তার জন্য মসজিদ ঘিরে রাখে৷ বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই হেফাজত ও কওমীপন্থিরা অবস্থান নেন প্রেসক্লাব ও কাকরাইল মসজিদের আশপাশে৷ তারা ঘোষণা দেন, সা'দকে ইজতেমায় যেতে দেবেন না এবং তাকে ভারতে ফিরে যেতে হবে৷ তাদের অভিযোগ ইসলাম নিয়ে কিছু ‘বিতর্কিত' মন্তব্য করেছেন মাওলানা সা'দ৷
পরিস্থতি নিয়ে বিকেলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে বৈঠক করেন সা'দবিরোধী ও পক্ষের মাওলানারা৷ বৈঠক শেষে সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল সংবাদ মাধ্যমকে জানান,‘‘মাওলানা সা'দ ইজতেমা মাঠে যাবেন না৷ ইজতেমা চলাকালে তিনি কাকরাইল মসজিদে থাকবেন, পরে সুবিধাজনক সময়ে দেশে ফিরে যাবেন৷''
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, ‘‘মাওলানা সা'দ-এর বক্তব্য নিয়ে তাবলিগ জামাতের মুরব্বি ও আলেমদের মধ্যে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছিল৷ এই বৈঠকে দুই পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে সুষ্ঠু সমাধান হয়েছে৷ উভয়পক্ষ এ সমঝোতা প্রস্তাব মেনে নিয়েছেন৷''
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘‘ইজতেমার বিষয়ে সরকার কখনোই হস্তক্ষেপ করেনি, এবারও করবে না৷ ইজতেমার নিরাপত্তায় সব ধরনের সহযোগিতা বরাবরের মতো এবারও দেয়া হবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘এ ইস্যুকে ঘিরে যারা রাস্তা-ঘাটে নেমেছিলেন, আশা করছি তারাও আজ ফিরে যাবেন৷ আর মাওলানা সা'দ যে মন্তব্য করেছেন, তার যৌক্তিকতা নিয়ে আলেমরা নিজেরা বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেবেন৷ এ বিষয়ে সরকারের কোনও বক্তব্য নাই৷'' সমঝোতা বৈঠকের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়া বিবদমান দুই গ্রুপের কেউ সেখানে সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেননি৷
এর আগে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা মহানগরীর যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা ফজলুল করীম কাসেমী ডয়চে ভেলেকে বলেনন,‘‘মাওলানা সা'দ কিছু বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন এর আগে৷ আমরা বলেছিলাম সেই বিষয়গুলো নিয়ে একটি সিদ্ধান্তে আসতে হবে৷ তারপর তিনি ইজতেমায় আসবেন৷ কিন্তু গত বছরও জোর করে এসেছেন৷ কিন্তু এবার এলেও তাকে আমরা ইজতেমায় অংশ নিতে দেবো না৷ তাকে দিল্লি ফিরে যেতে হবে৷''
তাবলিগের ব্যাপারে হেফাজতের কেন মাথাব্যথা– এই প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘‘আমরা হেফাজতের হলেও একই সঙ্গে তাবলিগের সঙ্গেও কাজ করি৷ আমাদের শত শত মুসুল্লি তাবলিগের কাজে সময় দেন৷ আমরা তাবলিগ হিসেবেই তার বিরোধিতা করছি৷ আর আমরা ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসার অনুসারী৷ তাবলিগ সৃষ্টি করেছেন ভারতের দেওবন্দের মাওলানা ইলিয়াস আহমেদ৷ আমরা তার গড়া দাওয়াতি প্রতিষ্ঠানকে বিতর্কিত হতে দিতে পারি না৷''
তিনি কী ধরনের বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন জানতে চাইলে হেফাজতের এই নেতা বলেন, ‘‘তিনি কোরান, হাদিস সম্পর্কে অনভিজ্ঞ, তিনি কোরান হাদিসের অপব্যাখ্যা দিয়েছেন৷ মাওলানা আল্লামা শফি মত দিয়েছেন যে, তিনি তাবলিগের নেতৃত্ব দেয়ার অযোগ্য৷ কিন্তু তিনি নিজেই নিজেকে তাবলিগের আমীর ঘোষণা করেছেন৷ আর মাওলানা শফির মতকে শুধু তাবলিগ নয় এই উপমহাদেশের সব আলেমরাই সম্মান করেন৷''
মাওলানা সা'দবিরোধী তাবলিগ জামায়াতের কওমীপন্থি নেতা মাওলানা শাহরিয়ার মাহমুদ মওলানা সা'দের বিরোধিতার কয়েকটি কারণ বলেন ডয়চে ভেলেকে৷ তার মতে, ‘‘মাওলানা সা'দ হযরত ঈসাকে নিয়ে অসম্মানজন কথা বলেছেন, বলেছেন কোরান বুঝে পড়া ওয়াজিব৷ আর বলেছেন, হেদায়েত আল্লাহর হাতে হলে নবীজীকে কেন পাঠানো হয়েছে৷ তিনি বলেছেন, পকেটে মোবাইল ফোন নিয়ে নামাজ পড়া নাজায়েজ৷ তার এসব কথা নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি করেছে৷''
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘মাওলানা সা'দ বলেছেন, মাদ্রাসায় টাকার বিনিময়ে পড়ানো যৌনকর্মীদের টাকা উপার্জনের মতোই৷ বেতনের বিনিময়ে মাদ্রাসায় পড়ানোর তিনি বিরোধী৷''
তবে তিনি দাবি করেন, ‘‘মাদ্রাসায় টাকার বিনিময়ে পড়ানোর বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য নয়, তার অন্যান্য মন্তব্যের জন্যই আলেমরা তার বিরোধিতা করছেন৷''
এসব নিয়ে মাওলানা সা'দ পন্থিদের কয়েকজনের সঙ্গে যেগাযোগ করা হলেও কেউ কোনো মন্তব্য করেননি৷ তবে বাংলাদেশে তাবলিগের মূল কেন্দ্র কাকরাইল মসজিদ সা'দপন্থিদের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে৷ জানা গেছে, তারা এখনো প্রকাশ্যে কোনো বক্তব্য না দিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন৷