‘মানুষ নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে’
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯বৃহস্পতিবার সকাল আটটায় ভোটগ্রহণ শুরু হয়৷ কিন্তু অনেক কেন্দ্রেই সকাল ১০টায়ও ভোটারের দেখা মেলেনি৷ এমনকি কোনো কোনো কেন্দ্রে ভোট শুরুর আড়াই ঘণ্টার মধ্যে একটিও ভোট পড়েনি৷ সেই অভিজ্ঞতার কথা ডয়চে ভেলেকে জানান সাংবাদিক সঞ্চিতা সিতু৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি পূর্ব রামপুরা এলাকায় নারী ভোটকেন্দ্রগুলোতে গিয়েছিলাম৷ সেখানে হলি ক্রিসেন্ট ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এবং আইডিয়াল স্কুলের কয়েকটি কেন্দ্র আমি দেখেছি৷ হলি ক্রিসেন্ট স্কুলে নারীদের তিনটি ভোটকেন্দ্র ছিল৷ সেখানে সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত কোনো ভোট পড়েনি৷ কল্যাণী রানী নামে একজন ভোটার গিয়েছিলেন৷ কিন্তু তাঁর নামের সঙ্গে ভোটার লিস্টের অমিল থাকায় তিনি ভোট দিতে পারেননি৷ এরপর বনশ্রী আইডিয়াল স্কুলে গিয়ে দেখি একটি কেন্দ্রে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ভোট পড়েছে ৫টি৷’’
সিতু বলেন, ‘‘প্রথম আড়াই ঘণ্টায় হলি ক্রিসেন্ট ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে কোনো ভোট না পড়লেও প্রিজাইডিং অফিসার হাসানুজ্জামান কিন্তু তখন দাবি করেন ভোট পড়েছে, পরে হিসাব দেবেন৷ তবে পরিস্থিতি দেখে আমি আর কিছু বলিনি৷ এরপর দুপুর দেড়টার দিকে আমি আবার ওই ভোটকেন্দ্রে যাই৷ তখনো ভোটকেন্দ্রে কোনো ভোটার ছিলনা, পুরো ফাঁকা৷ আমি হিসেব নিয়ে একটি বুথে চারটি এবং আরেকটি বুথে আটটি ভোট পড়েছে বলে জানতে পারি৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘ভোটার না আসার কারণ জানতে কোনো ভোটারের সঙ্গে আমি কথা বলতে পারিনি৷ ভোটারইতো আসেনি, কথা বলবো কীভাবে? তবে একজন প্রিজাইডিং অফিসার আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, মনে হয় তিনদিনের ছুটিতে সবাই বাড়ি চলে গেছেন৷’’
প্রার্থীদের বক্তব্য
জাতীয় পার্টি থেকে মেয়র প্রার্থী শাফিন আহমেদ সকালে সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘ভোটকেন্দ্রগুলো ঘুরেও আমি ভোটারদের কোনো দেখা পাইনি৷'' আওয়ামী লীগের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম সকালের বৃষ্টিকে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার জন্য দায়ী করেন৷ তবে পরে রোদ উঠলেও ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিত বাড়েনি৷
প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পার্টির মেয়র প্রার্থী শাহীন খান বলেন, ‘‘ভোটার উপস্থিতি খুবই কম৷ ৩-৪ পার্সেন্টের বেশি হবেনা৷ আমি দুপুর ১২টায় তেজগাঁ রাজধানী উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দেই৷ ওই সময় আমি ছিলাম চতুর্থ ভোটার৷’’
ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘ভোটের উপরে মানুষের আস্থা নেই৷ গত নির্বাচনে ভোটের আগের রাতেই ভোট হয়ে যাওয়ায় মানুষ ভোটের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে৷ তাঁরা মনে করেছেন ভোট দিয়ে আর লাভ কী! ছুটি পেয়েছি ঘুমাই৷’’
আগ্রহ কমে যাওয়ার কারণ জানতে কি ভোটারদের সঙ্গে কথা বলেছেন? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘ভাই ভোটারইতো নাই৷ কথা বলবো কার সঙ্গে!’’
স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী আব্দুর রহিম বলেন, ‘‘আমি সকাল ১০টায় ভাসানটেক উচ্চবিদ্যালয়ে ভোট দিই৷ আমিই ছিলাম প্রথম ভোটার৷ এর আগে কেউ ভোট দেয়নি৷ এরপর ওই এলাকায় আরো দুই-আড়াই ঘণ্টা ছিলাম৷ তেমন কোনো ভোটার আমার চোখে পড়েনি৷’’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘গত নির্বাচনের পর এখন মানুষ ভোটকেন্দ্রে আসতে ভয় পায়৷’’
নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের বক্তব্য
মাহবুব তালুকদার তাঁর নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘ডিএনসিসি মেয়র পদে উপনির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি৷ রাজনৈতিক পরিচয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও প্রধান বিরোধী দলগুলো অংশ নেয়নি৷ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে তাতে ভোটারদের ভোট দিতে যেতে উৎসাহ দেখা যায় না৷’’
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘‘আমি মগবাজারস্থ ইস্পাহানি ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করেছি৷ সরকার দলীয় মেয়রের পোলিং এজেন্ট ছাড়া আর কারও পোলিং এজেন্ট সেখানে ছিল না৷ সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত একই ভবনে অবস্থিত পাঁচটি কেন্দ্রের ১৫টি বুথে মাত্র ৩৮৫ জন ভোট দিয়েছেন৷ ওই পাঁচ কেন্দ্রে ভোটার রয়েছে ৯ হাজার ৪১৩ জন৷’’
আর সকাল ১০টার দিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা বলেন, ‘‘ভোটকেন্দ্রে কম ভোটার আসার দায় নির্বাচন কমিশনের নয়৷ এই দায় রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের৷’’
ভোটারের কম উপস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘স্বল্প সময়ে বা এক বছরের জন্য মেয়র ও কাউন্সিলরদের নির্বাচন হচ্ছে৷ এ কারণে ভোটারদের আগ্রহ কম হতে পারে৷ আবার সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ও প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকায় ভোটার উপস্থিতি কম হতে পারে৷’’
সাবেক কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন যা বললেন
নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ না হলে ভোটারের উপস্থিতি এরকমই হয় বলে মনে করেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মানুষ নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে৷ এর কারণ হলো, আগেই দেখেছে ভোটাররা ভোট দিতে পারছেন না, তাদের ভোট আগেই হয়ে যায়, বুথ দখল হয়ে যায়৷ আগের বড় নির্বাচনগুলোতে যা হয়েছে তার প্রভাব পড়ছে৷ সামনে উপজেলা নির্বাচনেও এর প্রভাব পড়বে৷’’
তাঁর মতে, ‘‘মানুষের মনের মধ্যে একটা কথা, আমি গেলেই কী, না গেলেই কী? এই রকম ধারণা যখন জন্মে তখন ভোটের প্রতি মানুষের আগ্রহ থাকেনা৷ দ্বিতীয়ত হচ্ছে, যদি নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ না হয় সেখানে গিয়ে মানুষ কাকে ভোট দেবে? আর তৃতীয়ত, ভোটের প্রতি মানুষ আস্থা হারিয়েছে৷’’
নির্বাচিত মেয়র মাত্র একবছর ক্ষমতায় থাকবেন, সে কারণে মানুষের আগ্রহ কম কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘সেটা বিষয় নয়, মানুষতো আগে ৬ মাসের জন্যও ভোট দিয়েছে৷ আসল কথা হলো মানুষ লস্ট ইন্টারেস্ট৷’’
আরেক প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘‘নির্বাচন কমিশনতো সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করবে৷ তবে ভোটার উপস্থিতির জন্য দায় প্রার্থী এবং রাজনৈতিক দলগুলোর, ভোটারদেরও৷ তবে তাঁরা আগ্রহ হারিয়ে ফেললে আর কী করা যাবে!’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘কেউ কেউ বলছেন ভোট পড়েছে পাঁচ ভাগ৷ এখন ভোটের ফল নির্বাচন কমিশন কী দেয় সেটাও দেখার বিষয়৷’’
প্রসঙ্গত, ডিএনসিসি'র মেয়র উপনির্বাচন ছাড়াও উত্তর ও দক্ষিণের ৩৬টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর নির্বাচনও হয়েছে৷ সীমানা জটিলতার কারণে আগে ওই ওয়ার্ডগুলোতে নির্বাচন হয়নি৷ মেয়র উপনির্বাচনে ভোটারদের তেমন আগ্রহ না থাকলেও ওই ৩৬টি ওয়ার্ডের ভোট কেন্দ্রগুলোতে ছিল ভোটারদের লম্বা লাইন৷ ভোটারদের উপস্থিতি ছিল সন্তোষজনক৷
ইসি সচিবের দাবি
নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে বিকেল চারটায়৷ এরপর নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেছেন, ‘‘ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে উপ-নির্বাচন ও দুই সিটির (উত্তর ও দক্ষিণ) সম্প্রসারিত অংশে কাউন্সিলর পদে নির্বাচনে সব মিলিয়ে ৫০ শতাংশের মতো ভোট পড়তে পারে৷'' তিনি বলেন, অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট হয়েছে৷’’
ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি কম থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‘মেয়র পদে উপ-নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকায় ভোটারদের উপস্থিতি কম ছিল৷ তবে যেসব কেন্দ্রে কাউন্সিলর পদে ভোট হয়েছে সেখানে ভোটার উপস্থিতি অনেক বেশি ছিল৷’’
যে কারণে উপ-নির্বাচন
২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুতে মেয়র পদ শূন্য হয়৷ নির্বাচন কমিশন গত বছরের ২৬ জানুয়ারি মেয়র পদে উপ-নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছিল৷ কিন্তু তার আগেই ওই বছরের ১৪ জানুয়ারি মেয়র পদে উপ-নির্বাচন ছয় মাসের জন্য স্থগিতাদেশ দেন হাইকোর্ট৷ আর গত ১৬ জানুয়ারি হাইকোর্ট জানায়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) উপ-নির্বাচনে আর কোনো বাধা নেই৷ এরপর নির্বাচন কমিশন ২৮ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের দিন ঠিক করে৷
প্রথমবার উপ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে প্রার্থী ঘোষণা করেছিল৷ কিন্তু ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়৷ তাই বৃহস্পতিবারের (২৮ ফেব্রুয়ারি) নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি এবং বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট৷
দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে এবার মোট মেয়র প্রার্থী পাঁচ জন৷ আওয়ামী লীগ থেকে আতিকুল ইসলাম, জাতীয় পার্টি থেকে শাফিন আহমেদ, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি থেকে আনিসুর রহমান দেওয়ান, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পার্টির শাহীন খান এবং একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুর রহিম৷ ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মোট ভোটার সংখ্যা ৩০ লাখ ৩৫ হাজার ৬২১ জন৷