মানুষের ভালোর জন্য
২১ আগস্ট ২০১৩ইয়ানা জুকার এক ৩৩ বছর বয়সি জার্মান তরুণী৷ ব্লন্দিনীও বটে, অর্থাৎ সোনালি চুল৷ তাঁকে দেখা গেল বার্লিনের টিয়ারগার্টেন উদ্যানে, পাখির খোঁজে৷ এই গাছের মাথা থেকে ওই গাছের মাথায় চোখ ছুটোছুটি করছে: কোথায় কোন পাখির দেখা পাওয়া যায়৷ তাহলে কি ইয়ানা অর্নিথোলজিস্ট, মানে পক্ষিবিশারদ?
ইয়ানার সঙ্গে আবার জনা বিশেক স্ত্রী-পুরুষের এক ছোটখাটো জনতা৷ এদেরই নেত্রী তিনি৷ তাহলে বলে ফেলা যাক: ইয়ানা জুকার জার্মানির প্রকৃতি সুরক্ষা সমিতি ‘নাবু'-র হয়ে ‘আফ্টার ওয়ার্ক বার্ডিং' বা ‘কাজের পর পাখি দেখা' নামের একটি প্রোগ্রাম করেন – মানে করান৷ নাবু হলো জার্মানির বৃহত্তম পরিবেশ সংগঠনগুলির মধ্যে একটি৷
নাবুর স্বেচ্ছাসেবীরা গ্রীষ্মে ছোটপাখিদের বাসা বাঁধার জন্য যে সব লেটারবক্সের মতো দেখতে কাঠের বাকসো ঝোলান, সেগুলোকে পরিষ্কার রাখার কাজ করেন ইয়ানা৷ আবার আগ্রহী মানুষজনকে বার্লিনের পক্ষিজগত চেনানোর কাজও করেন৷ তবে পাখি দেখা হলো ইয়ানার নেশা৷ পেশা বলতে তিনি একটি ওষুধের কোম্পানির প্রোডাক্ট ম্যানেজার৷
কাজ আর অকাজ
আজ টিয়ারগার্টেনের পাখিদের বোধহয় মানুষের দিকে মন নেই, তাই পাখিরা বিরল৷ কোথায় একটি ব্লাউমাইজে বা ব্লু টিট পাখি উঁকি মেরেছে, ইয়ানা সেটা দেখতে পেয়ে দলের বাকিদের ডাকলেন৷ সবাই বাইনকুলার চোখে দিয়ে সেই চড়ুইপাখির সাইজের পাখিটা খুঁজছেন৷ কিন্তু পাখির তো শুধু চেহারাই নয়, গানও আছে৷ টিয়ারগার্টেনের যত ভিতরে যাওয়া যাবে, ততই আরো বেশি কানে আসবে পাখিদের গান৷ পাখিদের গলা চিনতে শেখাচ্ছেন ইয়ানা এই আনকোরা রংরুটদের৷
ইয়ানা নাবুর স্বেচ্ছাসেবী, ‘এহরেনআম্টলিশ'৷ তাঁর লক্ষ্য হলো: ‘‘ব্রিটেনে যেমন পাখি দেখাটা একটা সার্বজনীন হবি, জার্মানিতেও সেরকমটাই হয়ে উঠুক, এটাই হলো আমার স্বপ্ন৷'' কেননা পাখি দেখা মানেই পাখিদের সুরক্ষা৷ পাখিদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে গিয়ে ইয়ানা যদি নিজেও মুক্ত প্রকৃতিতে কিছুটা সময় কাটাতে পারেন, তবে তা-তে ক্ষতি কি? তাঁরও তো সারাদিন কাটে অফিসে৷ তাই ‘কাজের পর পাখি দেখা'৷
পরের ভালো করা মানে নিজের ভালো করা
বিলেফেল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ববিদ বারবারা মশনার বলেন, স্বেচ্ছাসেবীর কাজ খোঁজার সময়েও নিজের স্বার্থটা ঠিকই কাজ করে এবং তা-তে খারাপ কিছু নেই৷ ‘‘ অন্যের ভালো বা পরের মঙ্গল প্রাথমিক হলেও, মানুষের সব কাজেরই একটা স্বার্থের দিক আছে৷'' বলতে কি, স্বেচ্ছাসেবীর কাজের সঙ্গে যদি তার ব্যক্তিগত আগ্রহ, লক্ষ্য, এমনকি কল্পনা-কামনা মিশে যায়, তবেই স্বেচ্ছাসেবীর উদ্যোগ দীর্ঘস্থায়ী হয়৷
৭০ বছর বয়সি ইয়ুর্গেন লুবনাউ বলেন, তিনি সারা জীবন ধরে ভলান্টিয়ারের কাজ করছেন৷ সেটাই নাকি তাঁকে তরুণ রেখেছে৷ কয়েক বছর আগে অবসর নিয়েছেন লুবনাউ৷ ছোটবেলাতেই চোখের দৃষ্টি হারান তিনি৷ অন্ধদের জন্য বার্লিনে একটি বিশেষ সংগ্রহশালা আছে৷ তার যে পৃষ্ঠপোষক সমিতি, সেই সমিতির সভাপতি হলেন লুবনাউ৷ সদ্য তিনি এক স্থপতির সঙ্গে মিউজিয়ামটা নতুন করে সাজানো নিয়ে কথাবার্তা বলেছেন৷
পরকে সাহায্য করা মানে নিজেকে সাহায্য করা
ইয়ুর্গেন লুবনাউ এককালে ম্যারাথন দৌড়ে অংশ নিতেন, অন্ধ হিসেবেই৷ তখন তাঁর সাথে চোখে দেখতে পায়, এমন কাউকে রানার হিসেবে থাকতে হতো – এমনকি ট্রেনিং-এর সময়েও৷ এই রানাররা কিন্তু ছিলেন স্বেচ্ছাসেবী, ভলান্টিয়ার৷ তাদের প্রতি লুবনাউ-এর গভীর কৃতজ্ঞতাবোধ৷ কিন্তু সেই সঙ্গে তাঁর এ-ও মনে আছে যে, এই সব রানাররা খুশিমনেই এক অন্ধের সঙ্গে দৌড়েছেন, আদৌ সেটাকে ঝক্কি বলে মনে করেননি৷
‘এহরেনআম্টলিশ' আর কা-কে বলে!