ইটালির নারী
৬ ডিসেম্বর ২০১২‘স্প্যাগেটি বোলোনেসে', ‘পিৎসা' অথবা শেষ পাতে ‘টিরামিসু' – নামগুলো শুনলেই জিভে কেমন জল চলে আসে, তাই না? কিন্তু কখনও কি ভেবেছেন সেই মানুষগুলোর কথা, যাঁদের সারা দিন ধরে এই সব লোভনীয় খাবার বানাতে হয়?
হ্যাঁ, বলছি ইটালির মায়েদের কথা৷ ইটালীয় ভাষায় যাঁদের ডাকা হয় ‘মাম্মা' বলে৷ সাধারণভাবে বাঙালি মায়েদের সঙ্গে ইটালীয় মাম্মাদের একটা বড় মিল আছে৷ আর সেটা হলো, দু'জনকেই দিনের বেশিরভাগ সময় কাটাতে হয় রান্নাঘরে, স্বামী-পুত্রের জন্য মজার মজার সুস্বাদু খাবার-দাবার বানাতে৷ তাই বাঙালি ছেলেরা যেমন মা-ন্যাওটা হয়, ইটালির পুরুষরাও নাকি হয় মাম্মা-ভক্ত৷ অন্তত মোটের ওপর এমন কথাই শোনা যায় সচরাচর!
তাই ইটালীয় নারী বলতেই কেন যেন বেশ মোটাসোটা, রন্ধনে পটু মায়েদের ছবিই ভেসে ওঠে৷ আর তা হবে নাই বা কেন? ইটালিতে যে নারীর সমান অধিকার, নারীর প্রতি বঞ্চনা প্রতিরোধে শক্ত নীতিমালা এবং স্বাস্থ্য সেবার সুযোগ নিয়ে কথাবার্তা হয় খুবই কম৷ সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষাতেও দেখা গেছে যে, নারীদের জন্য সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে ইউরোপে প্রথম তিনটি দেশের মধ্যে ইটালি নেই৷ জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সের পর চতুর্থ স্থানে রয়েছে ইটালি৷
ইউরোপীয় দেশ হওয়া সত্ত্বেও ইটালিতে যাঁরা অফিস-আদালতে, জাতীয় বা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কাজ করেন, তাঁদের মাসিক বেতনও কিন্তু পুরুষের তুলনায় কম হয়৷ পুরুষতন্ত্রের প্রভাব সেখানে চোখে পড়ে আজও৷ যেখানে শুধু বেতনের পার্থক্যই নয়, মাতৃত্বজনিত ছুটি অথবা সুযোগ-সুবিধাও সেখানে অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের তুলনায় অনেক কম৷
ওদিকে, স্বাধীনতার একেবারে প্রথম লগ্নেই কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার নারীরা পেয়েছিলেন সম্পূর্ণ রাজনৈতিক অধিকার – ভোটের অধিকার৷ আর এতদিন পুরুষের কাজ বলা হতো যাকে, তার অধিকাংশ জয় করেছেন মেয়েরা৷ নারী-পুরুষের কাজে আর মগজে আজ আর কোনো দুস্তর ফারাক খুঁজে পাওয়া যায় না৷ যদিও মেয়েদের এখনও বাকরুদ্ধ করে থাকে সমাজ, ধর্ম, পরিবার – সকলেই৷
তবে হালের অর্থনৈতিক মন্দা এবং পড়তি জন্মহারের কারণে এবার বহু ইটালীয় নারীই বাড়ির চার গণ্ডি ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে চাইছেন৷ চাইছেন ‘মা' নয়, ‘ম্যানেজার' হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে৷ আর সে জন্য বহু নারীই এখন মাতৃত্বের স্বাদ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতেও পিছ-পা হন না৷ ইটালির জাতীয় সামাজিক ইন্সটিটিউটের একটি সমীক্ষা থেকেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায়৷ সমীক্ষাটি থেকে জানা যায় যে, ২০১২ সালে ইটালির প্রায় ১ দশমিক ৪ শতাংশ নারী সন্তান চাইছেন না৷
একটা সময় যাঁরা সারাটা দিন রান্নাঘরে কাটিয়ে দিতেন হাসি মুখে, আজ তাঁরাই নাকি ১৫ মিনিটের বেশি দিতে চাইছেন না রান্নার জন্য৷ সংখ্যার বিচারে এরা প্রায় ২২ শতাংশ৷ এতে বাড়ির পুরুষদের মেজাজও যাচ্ছে বিগড়ে৷ ইটালির প্রায় ৪০ শতাংশ পুরুষ আজ-কাল বাড়ির তৈরি খাবারের সমালোচনা করছেন৷ তাঁদের মতে, আধুনিক এই নারীরা টিভি'র পর্দায় বিভিন্ন রকম ‘কুকারি শো' বা রান্নার অনুষ্ঠান দেখে দেখে ব্যঞ্জন তৈরি করলেও, তা স্বাদে-গন্ধে আগের মতো হচ্ছে না৷ যে মায়েরা আদৌ রোজ রান্নাঘরে ঢুকছেন, তাঁদের বেশিরভাগই ঢুকছেন সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে৷ স্বামী বা পুরুষবন্ধুর জন্য তাঁদের সে রকম আর মাথা ব্যথা নেই৷
পাদুয়া শহরের মনস্তত্ত্ববিদ সেরেনেলা সালোমনির কথায়, ‘‘ইটালীয় নারীরা বর্তমানে অনেক কম সময় রান্নাঘরে কাটাচ্ছেন৷ তাঁর জীবন আর রান্না করা-বাসন মাজার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই৷ আসলে আজ তাঁরা দৃঢ় স্বরে ‘না' বলতে শিখে গেছেন৷ শুরু করেছেন নিজের কথা ভাবতে৷''
দুঃখের বিষয়, এরপরও কিন্তু বাড়ির প্রায় ৭০ শতাংশ কাজ করতে হচ্ছে সেই নারীকেই৷ ঘর পরিষ্কার করা, কাপড় ধোয়া – এসব তাঁদের করেই যেতে হচ্ছে৷ অর্থাৎ, দক্ষিণ এশিয়ার বহু দেশের মতো ইটালিতেও মেয়েদের ঘরে-বাইরে – দুটি জায়গা বা ‘স্পেস'-ই সামলাতে হচ্ছে৷ অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজনে কম বেতন নিতে হচ্ছে মাথা পেতে৷ এর সঙ্গে সঙ্গে করতে হচ্ছে বাচ্চাদের দেখাশোনাও৷
পুরো কাজটা যে এত সহজ নয়, সেটা তাঁরা বুঝতে পারছেন প্রতিদিনই৷ আর সে জন্যই ‘মাম্মা' এবং ‘ম্যানেজার'-এর মধ্যে ম্যানেজারিটাকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছেন অনেকে৷