পাখি শিকার
২৪ জুলাই ২০১৫আবার পাখি শিকারের দিন এসেছে! লুকাস মিকালেফ যখন প্রথমবার বন্দুক হাতে ধরেন, তখন তাঁর বয়স ছিল দশ বছর৷ আজ তাঁর বয়স ছাব্বিশ৷ কিন্তু প্রতি বছর বসন্তে পাখিশিকার তাঁর কাছে আজও একটা বিশেষ অনুভূতি৷ কেননা এটা হল ঘুঘু আর তিতিরপাখি শিকারের মরসুম৷
লুকাস-কে অতি দ্রুত তাক করে গুলি চালাতে হয়৷ লক্ষ্য হলো, যে সব মরসুমি পাখি আফ্রিকা থেকে মাল্টা হয়ে ইউরোপের দিকে যাচ্ছে – স্থানীয় পাখিরা নয়৷ লুকাস বলেন: ‘‘পঁচিশ থেকে ত্রিশ মিটার দূরত্ব থেকে গুলি করলে, তাক ভালো হয়৷'' তারপর চালাও গুলি! সর্বত্র ঘাপটি মেরে বসে রয়েছেন শিকারিরা৷ ঘুঘুপাখি শিকারের আদর্শ দিন৷ তবে লুকাস কিছুটা হতাশ: ‘‘গুলি লাগানো শক্ত, ওরা অত্যন্ত তাড়াতাড়ি ওড়ে বলে৷ মুহূর্তের মধ্যে সরে যায়! কাজেই একবার মিস করলে, সেটাই শেষ সুযোগ৷''
মাল্টার বহু মানুষের কাছে পাখিশিকার একটি সুপ্রাচীন পারিবারিক ট্র্যাডিশন৷ অন্যান্য শিকারিদের মতো লুকাস-ও পাখিশিকার শিখেছেন তাঁর বাপ-পিতামহর কাছে৷ প্রতি বছর মাল্টার শিকারিরা এগারো হাজার ঘুঘু আর পাঁচ হাজার তিতির মারতে পারেন – সেটাই তাঁদের বরাদ্দ৷ মাল্টার শিকারিরা ব্রাসেলসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছ থেকে আবার একটা বিশেষ অনুমতির ব্যবস্থা করেছেন – পরিবেশ সংরক্ষণকারীরা যা নিয়ে চিন্তিত৷
টিলার উপর
লুকাস আমাদের সাগরপারের টিলায় নিয়ে গেলেন৷ মরসুমি পাখিরা সাগর পার হয়ে এসে এখানেই বিশ্রাম নেয়৷ কাজেই জায়গাটা পাখিশিকারিদের স্বর্গ৷ প্রত্যেক পঞ্চাশ মিটার অন্তর বন্দুক হাতে একজন শিকারি৷ লুকাস মাইকেল-এর কাছে এসে দাঁড়ালেন৷ মাইকেল বন্দুক, গুলিবারুদ আমদানি করে থাকেন৷ আজ তিনি এক দঙ্গল পাখিশিকারিকে নির্দেশ দিচ্ছেন, পরিচালনা করছেন৷ দ্বিপ্রহর অবধি শিকার চলবে৷ ঠিক দুপুর একটায় শিকারিদের বন্দুক খাপে ভরতে হবে৷
পাখি বাঁচানোর নেশা
পশুপ্রেমীরা শিকারিদের ওপর নজর রেখেছেন; খেয়াল রাখছেন, যাতে তারা নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে গুলি না চালায়৷ আক্সেল হিয়র্শফেল্ড প্রতি বছর জার্মানি থেকে মাল্টা আসেন পাখিশিকারিদের হাত থেকে মরসুমি পাখিদের বাঁচানোর জন্য – অন্তত যতোটা পারা যায়৷ ‘পাখিহত্যা প্রতিরোধ কমিটি'-র পশুপ্রেমী আক্সেল হিয়রশফেল্ড বলেন, ‘‘মাল্টা সারা বিশ্বে একটা ব্যতিক্রম৷ দ্বীপটির আয়তন ও জনসংখ্যার কথা ভাবলে, পৃথিবীর আর কোনো জায়গায় একসঙ্গে এতোজন মানুষ শিকার করেন না৷ এর ফলে যে সব পাখি শিকার করা চলে অথবা চলে না, সকলেরই এই দ্বীপে এলে আর বাঁচার উপায় থাকে না৷''
সেই সঙ্গে রয়েছে বেআইনি পাখিশিকার৷ পশুপ্রেমীরা সেদিকেও নজর রাখেন৷ এখানে যেমন তারা একটি মরা কোকিল খুঁজে পেয়েছেন৷ কোকিল মারা আসলে নিষিদ্ধ৷ কিন্তু কিছু শিকারি পয়সার জন্য সব কিছু করতে পারেন৷ হিয়রশফেল্ড বলেন, ‘‘একটা ব্ল্যাক স্টর্ক বা সারসপাখি, কিংবা কোনো জাতের ঈগল পাখি মারতে পারলে, তা থেকে অনেক টাকা রোজগার করা যায়৷ কালোবাজারে ঐ ধরনের একটি খড়-পোরা, পালকসহ বাজপাখির দাম বেশ কয়েক হাজার ইউরো৷''
পাখিশিকার একটা ট্র্যাডিশন
অপরদিকে পাখিশিকারি লুকাস মিকালেফ-এর মতে: ‘‘ওরা বেআইনি পাখিশিকারে আইনসম্মত পাখিশিকারের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে৷ যারা বেআইনিভাবে পাখি মারে, তারা শিকারি নয়, তারা অপরাধী৷''
শিকারিদের এখন পোয়াবারো৷ গত এপ্রিল মাসের একটি গণভোটে মাল্টার অধিবাসীদের একটি সব মিলিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ পাখিশিকারের সপক্ষে ভোট দিয়েছে৷ কাজেই মাল্টা এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের একমাত্র সদস্য দেশ, যেখানে বসন্তকালে পাখি মারা চলে৷
পাখিশিকারি আল্দো আৎসোপারদি বলেন, ‘‘আমাদের শিকারের শতকরা ৯৫ ভাগই হলো অলীক আশা! দু'টো পাখি মারলেই কোটা ফুরিয়ে বন্দুক কাঁধে করে বাড়ি যাওয়ার সময় – কেননা সেটাই আইন৷''
লুকাস এ যাবৎ একটিও পাখি মারতে পারেননি৷ কিন্তু তিনি আর অন্যান্য শিকারিদের কাছে ঐতিহ্যের মূল্য প্রাণী সংরক্ষণের চেয়ে অনেক বেশি৷ লুকাস বলেন, ‘‘আশা করব, আমার ছেলে কিংবা নাতিরাও পূর্বপুরুষের এই ঐতিহ্য বজায় রাখতে পারবে৷''
তবে পাখি শিকারের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা থেকে যাচ্ছে৷ নির্দিষ্ট সংখ্যার বেশি পাখি মারা হলে সরকার পাখিশিকার নিষিদ্ধ করতে চায়৷ একটি পাখি ইউরোপ অভিমুখে তার যাত্রা অব্যাহত রাখতে পারবে বলে আশা করা যেতে পারে – যদি না অন্য কোনো শিকারি ঘোড়া টিপে দেন!