‘দলিত সাংবাদিক' অনাকাঙ্খিত?
৭ জুন ২০১৭সম্প্রতি এমনই এক প্রশ্ন উঠে এসেছে কাতার-ভিত্তিক মিডিয়া সংস্থা আল-জাজিরার এক অনুসন্ধানী রিপোর্টে৷
ভারতের জাতীয় জীবনধারায় জাতপাতের ভেদাভেদ দলিতদের প্রতি বৈষম্য সেই আদিকাল থেকেই চলে আসছে৷ দেশ স্বাধীন হবার পর দলিতদের প্রতি বৈষম্য এবং বঞ্চনার কলঙ্ক মোচনে দেশের সংবিধান রচনার ভার দেওয়া হয় বিদ্বান দলিত নেতা ডক্টর বি.আর আম্বেদকরের ওপর৷ তিনি দেশের ২২ লাখ তপশিলি জাতি-উপজাতিকে অনগ্রসরতা ও অবিচার লাঘবে সংবিধানের প্রস্তাবনায় দলিত শ্রেণির জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থার সংস্থান রাখেন৷ সেটা তাঁদের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পায়৷ কিন্তু সেই বঞ্চনা, অবিচার, অত্যাচার কি শেষ হয়েছে ? ভূমিগত বাস্তবতা কিন্তু বলে অন্য কথা৷ সেখানে আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একই মানসিকতা আজও অব্যাহত আছে৷ তা সে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হোক, স্কলারশিপের ক্ষেত্রে হোক বা চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে হোক৷ খাতা কলমে যা থাকে, তাকে হামেশা বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সমাজের তথাকথিত উচ্চবর্গীয় শ্রেণি কারসাজি করে নিজেদের কাজ গুছিয়ে নেয়৷
নিউজ মিডিয়াগুলিতে সমাজের অনগ্রসর শ্রেণি, যাঁদের ‘দলিত' বলা হয়, প্রতিদিন তাঁদের উপর অবিচার, অত্যাচারের খবরাখবর ফলাও করে তুলে ধরা হয় ঠিকই৷ কিন্ত সাংবাদিকতায় দলিত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব কিন্তু অতি নগণ্য৷ মিডিয়া সংস্থাগুলিতেই নয়, দক্ষিণ ভারতের চেন্নাইয়ের ‘এশিয়ান কলেজ অফ জার্নালিজম' সংক্ষেপে এসিজে-এর মতো শিক্ষণ প্রতিষ্ঠানেও সমাজের উচ্চবর্গীয়দের আধিপত্যই চোখে পডে বেশি৷ গত বছর চেন্নাইয়ের এশিয়ান কলেজ অফ জার্নালিজমে ডাইভার্সিফাই প্রকল্প বাস্তবায়নেও পর্দার আড়ালে চলে নানা কারচুপি৷ আড়ালে কলকাঠি নাড়ানো হয়৷দলিত শ্রেণির পড়ুয়ারা যাতে কাছে ঘেঁষতে না পারে, তার জন্য নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়, যাতে তাঁরা ভর্তি হতে না পারে৷ এজন্য কলেজের শিক্ষক থেকে শুরু করে প্রশাসক– সবাই কমবেশি জড়িত৷ শেষ অবধি অবশ্য এই কারচুপি চেপে রাখা যায়নি৷ ফাঁস হয়ে যায়৷ দলিত ও পিছিয়ে পড়া জাতির হাতে গোনা কয়েকজন ভর্তি হলেও বা মিডিয়া হাউজে চাকরি পেলেও, তাঁরা নিজেদের দলিত পরিচয় গোপন রাখতেই চেষ্টা করেন৷
এশিয়ান কলেজ অফ জার্নালিজম-এর মতো এক নাম-করা জার্নালিজম কলেজে দলিত শিক্ষার্থীকে বিশেষ স্কলারশিপ দেবার ব্যবস্থা আছে৷ এই ব্যবস্থায় মধ্যবিত্ত উচ্চ-বর্গীয় ছাত্র সমাজ অসন্তুষ্ট৷ চুপিসারে তাঁরা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে৷ তাঁদের দাবি– এটা বৈষম্যমূলক৷ কাজেই এই ব্যবস্থা চলতে পারে না৷ সেক্ষেত্রে আর্থিক দিক থেকে অসচ্ছল, সমাজের উচ্চ-বর্গীয় পড়ুয়াদেরও অনুরূপ সুবিধা দিতে হবে৷ এই ধরণের খবরই উঠে এসেছেকাতারের দোহা-ভিত্তিক সংবাদ সংস্থা অাল-জাজিরার তথ্যানুসন্ধানি রিপোর্টে৷ এশিয়ান কলেজ অফ জার্নালিজম এবং দেশের অন্যসব প্রথম সারির ইংরেজি-মাধ্যমের বেসরকারি জার্নালিজম শিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই তথাকথিত উচ্চ-বর্গীয় শ্রেণির. ক্লাসের ভেতরে এবং বাইরে এবং প্রাক্তনী নেটওয়ার্কে এদের প্রভাব প্রতিপত্তি বেশি৷ দলিত শ্রেণিভুক্ত জার্নালিজম পড়ুয়ারা সেখানে হালে পানি পান না৷ প্রতিনিয়ত চলে তাঁদের উপর মানসিক উত্পীড়ন৷ ঘৃণা-বিদ্বেষে জর্জরিত হয়ে তাঁরা পড়ে মুখ থুবড়ে৷ অসহিষ্ণুতা, কুসংস্কার, ঘৃণা দলিতদের ঠেলে দেয় অচ্ছুত শ্রেণির দিকে৷ অবশেষে দলিতরা মুখ ফিরিয়ে বিদায় নেয়৷ গত বছর জুন মাসে চেন্নাইয়ের এশিয়ান কলেজ অফ জার্নালিজমে ভর্তি হয় ১৯০ জন পড়ুয়া৷ তাঁদের মধ্যে মাত্র ৬ জন দলিত শ্রেণির এবং একজন মাত্র আদিবাসি৷ বাদবাকি সবাই তথাকথিত উচ্চবর্গীয়৷ তবু তাঁরা টিকতে পারে না৷ অতি সম্প্রতি হায়দ্রাবাদের কেন্দ্রীয় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পি-এইচডি ছাত্র রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যার ঘটনা তারই জলন্ত উদাহরণ৷ রোহিতকে ছাত্র হস্টেলে থাকতে, ডাইনিং টেবিলে বসতে বাধা দেওয়া হয়৷ স্টাইপেন্ড ছাঁটাই করা হয়৷ অপমান আর লাঞ্ছনা সহ্য করতে না পেরে শেষমেশ সে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়৷ সেকথা রহিত তাঁর নিজের ডায়েরিতে লিখে যান৷ এই নিয়ে মিডিয়ায় তুমুল সোরগোল৷ ফলাও করে সেই ঘটনা ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় দিনের পর দিন তুলে ধরা হয়৷
এই প্রবণতা কি শুধু শিক্ষা ক্ষেত্রেই? সামাজিক ক্ষেত্রে আরও মর্মান্তিক৷দলিতদের মন্দিরে প্রবেশাধিকার নেই৷ উচ্চবর্গীয়দের কুয়ো থেকে জল তোলার অধিকার নেই, বেশি জমিজমা রাখার অধিকার নেই৷ এহ বাহ্য, এই তো, দিন দুয়েক আগে কর্নাটকের এক মুসলিম মেয়ে বানু বেগম ভালবেসে বিয়ে করেছিল এক দলিত যুবককে বাড়ির অমতে বাড়ি থেকে পালিয়ে৷ কিছুদিন পরে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় সে বাড়ি ফিরে এলে নিজের পরিবারের লোকজন তাঁকে কুপিয়ে জ্যান্ত জ্বলিয়ে দেয়৷ যাকে বলে অনার কিলিং৷ কারণ, বানু বেগমের অপরাধ– তিনি দলিত ছেলেকে নিকা করেছেন৷ এইসব কারণে বহু দলিত ধর্মান্তরিতও হচ্ছে৷