খালি পায়েই বাস থেকে নেমে জাহাজে উঠছিলেন অনেকে৷ তাদের কেউ হাফপ্যান্ট পরা, কেউ ট্রাউজার, কেউবা মিয়ানমারের সামরিক পোশাক পরা৷ মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর এই সদস্যরা অনেকটা হাসিমুখে দেশে ফিরছিলেন৷ তাদের মধ্যে আহতদের অ্যাম্বুলেন্সে করে জাহাজ অবধি নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷
চলতি মাসের শুরুর দিকে জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে যুদ্ধে টিকতে না পেরে নিজের দেশের সীমান্ত চৌকি ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলেন তারা৷ বাংলাদেশে মিয়ানমারের সেনাদের পালিয়ে আসার ঘটনা এটাই প্রথম৷
তবে তাদেরকে সীমান্তে যেভাবে গ্রহণ করা হয়েছে এবং সপ্তাহখানেকের মধ্যেই একেবারে সেদেশের কর্তৃপক্ষের হাতে সুন্দর করে জাহাজে তুলে ফেরত পাঠানো হয়েছে তা বিরলই বলা চলে৷
আমরা সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র দেখেছিলাম আব্দুর রাজ্জাকের ক্ষেত্রে৷ বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি)-র এই সদস্যকে ২০১৫ সালের জুনে টেকনাফের নাফ নদী থেকে ধরে নিয়ে যায় মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষীরা৷ তার হাতকড়া পরানো ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয় দেশটি৷ অনেক চেষ্টা-তদবিরের পর রাজ্জাককে ফেরত পায় বাংলাদেশ৷ তার দেহে তখন নির্যাতনের ছাপ স্পষ্ট ছিল৷
মিয়ানমারের পালিয়ে আসা সেনাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে দেয়া হয়নি সাংবাদিকদের৷ ফলে তাদের কথা সরাসরি শোনার সুযোগ মেলেনি৷ সেটা সম্ভব হলে রাখাইন অঞ্চলের যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে আরো বিস্তারিত জানা যেতো, বোঝা যেতো যুদ্ধ শুরুর পর হুড়হুড়িয়ে প্রতিবেশী দেশে পালানোটা কি শুধুই জান বাঁচাতে, নাকি যুদ্ধেরই কোনো কৌশল৷ এমন এক কৌশল যা পাল্টা অভিযান চালাতে সহায়ক হতে পারে বলে আলোচিত হচ্ছে বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চলে৷
মিয়ানমার যেভাবে তাদের চৌকি ছেড়ে পালিয়ে আসা সীমান্তরক্ষী, সৈনিক, শুল্ক কর্মকর্তাদের ফিরিয়ে নিয়েছে, তাতে একটা বিষয় বেশ পরিষ্কার হয়ে উঠেছে৷ তা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চাইলেও সেটা দেশটির জন্য কঠিন কিছু নয়৷ বরং একইভাবে দ্রুতই রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোও সম্ভব৷
তবে এই সম্ভবটা হচ্ছে না গত বেশ কয়েকবছর ধরে৷ বাংলাদেশ বারংবার চেষ্টা করেছে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দিতে৷ কিন্তু মিয়ানমার নানা বাহানায় তাদের নিচ্ছে না৷ রোহিঙ্গাদের নিজ দেশের নাগরিক মনে করে না নেপিডো৷ আর এই সংখ্যালঘুদের উপর দমনপীড়ন সেদেশে প্রকাশ্যেই করে দেশটির সামরিক বাহিনী৷
রাখাইন রাজ্যে স্বায়ত্তশাসন চায় আরাকান আর্মি৷ বর্তমান যে পরিস্থিতি তাতে এই রাজ্য যদি বিদ্রোহী গোষ্ঠীটির নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি চলে যায়, তাহলে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো আরো দুরুহ হয়ে পড়বে যদি না আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়৷
রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে চীন এবং ভারতের মধ্যেও প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে৷ দুদেশেরই নিজ নিজ স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে রাখাইনে৷ চীন সেখানে গ্যাস, বিদ্যুৎ, বন্দরের বড় প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে, ভারত এই রাজ্যের মধ্য দিয়ে মিজোরামে পণ্য পরিবহণের পথ করে নিয়েছে৷
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আরাকান আর্মির সঙ্গে ইতোমধ্যেই সম্পর্ক গড়ে তুলেছে চীন৷ তাদেরকে নানারকম সহায়তা করছে দেশটি, এমন তথ্য উঠে এসেছে সংবাদমাধ্যমে৷ আবার একইসঙ্গে জান্তা সরকারের সঙ্গেও চীনের সখ্যতা অব্যাহত রয়েছে৷
আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, চীনের ভাবনায় শুধু রাখাইন রাজ্যের সঙ্গে আরাকান আর্মি সম্পৃক্ত হচ্ছে৷ কেননা, এই রাজ্যে বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে৷ তবে বিদ্রোহীদের জোট এখনো ততটা শক্তিশালী না হওয়ায় গোটা মিয়ানমারের দখল নেয়ার পথে তারা অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে৷
ভারত অবশ্য এখনো কৌশলগতভাবে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সঙ্গে রয়েছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে৷ তারা আরাকান আর্মিকে সমর্থন করছে এমন কোনো তথ্য প্রকাশিত হয়নি৷
বাংলাদেশ এক্ষেত্রে বেশ জটিল অবস্থাতেই রয়েছে৷ রাজনৈতিক ইস্যুতে চীন, ভারত, রাশিয়া বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের পাশে আছে শোনা গেলেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের কারো সহায়তাই কার্যত আদায় করতে পারেনি ঢাকা৷
আরাকান আর্মি যদি দীর্ঘমেয়াদে রাখাইন রাজ্যে দখল প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তখন মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর আর কোনো পথ থাকবে না৷ সেদেশের জান্তা সরকার যে এই বিষয়ে তেমন একটা আগ্রহী, সেটাও নয়৷ অন্তত গত সাতবছরে একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো যায়নি৷
এদিকে, রোহিঙ্গাদের একাংশও আরাকান আর্মির হয়ে রাখাইনে গৃহযুদ্ধে অংশ নিচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে৷ সম্প্রতি সশস্ত্র বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গাকে সীমান্তে আটকও করেছে বিজিবি৷ কক্সবাজারের স্থানীয় সাংবাদিকরা জানাচ্ছেন, সীমান্তে এই অস্থিরতার মধ্যেও নিয়মিত জ্বালানি ও খাদ্য পাচার হচ্ছে রাখাইন অঞ্চলে৷
এক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন ক্রমশ জোরালো হচ্ছে৷ আনুষ্ঠানিকভাবে না হোক, অনানুষ্ঠানিকভাবে কি আরাকান আর্মির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা উচিত বাংলাদেশের? নিজ স্বার্থে ভারত, চীন অনেককিছুই করে৷ বাংলাদেশের স্বার্থ যদি হয় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত পাঠানো, সেক্ষেত্রে দেশটির জন্য সবচেয়ে ভালো পন্থা কোনটি? শীঘ্রই এসব বিষয় আরো স্বচ্ছ হবে বলে মনে হচ্ছে৷