অ্যানিমেশনে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ!
১৫ ডিসেম্বর ২০১৭ছবির নাম ‘সার্ভাইভিং ৭১ – অ্যান আনটোল্ড স্টোরি অফ অ্যান আননোন ওয়ার'৷ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কিছু গল্প দেখা যাবে এই অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রে৷
ডয়চে ভেলে: একাত্তর নিয়ে অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র তৈরির ভাবনা কীভাবে এলো?
ওয়াহিদ ইবনে রেজা: আসলে গল্পটা আমার মাথায় আসে ৫-৬ বছর আগে৷ এতদিন আগে থেকে আমি চরিত্রগুলো নিয়ে ভেবেছি, গল্পটা কেমন হবে সেটা নিয়ে ভেবেছি৷ আমাদের দেশে আপনি মুক্তিযুদ্ধের সিনেমাগুলো যদি দেখেন, আমরা বৃহৎ পরিসরে মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা নির্মাণ করতে পারি না৷ বড় পরিসরে গল্প বলাটা খুব কঠিন এবং ব্যয়বহুলও৷ তাই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যখন চলচ্চিত্রগুলো হয় ছোট ছোট গল্প নিয়ে হয়৷ তাই আমি চিন্তা করলাম যদি ‘গ্র্যান্ড স্কেলে' গল্প বলতে যাই, তাহলে অ্যানিমেশনটা আমাদের জন্য সোজা হবে, কারণ অ্যানিমেশনে চাইলে আমরা অনেক কিছু করতে পারবো৷ আমরা পুরোনো দিনের রাস্তা দেখাতে পারবো, আমাদের ‘আইকনিক ফিগার' দেখাতে পারবো, যেটা হয়ত লাইভ অ্যাকশনে দেখাতে পারবো না৷ তুলনামূলক ভাবে এতে কষ্ট কম হবে, আর্টিস্টিক হবে এবং নতুন প্রজন্ম, বিশেষ করে বাচ্চারা এ থেকে অনুপ্রাণিত হবে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে পারবে৷ অ্যানিমেশনের ফলে তাদের মধ্যে এটা দেখার আগ্রহ বেশি হবে৷
চলচ্চিত্রের গল্পটা কোথা থেকে নেয়া হয়েছে?
আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা৷ আমি আব্বুজির কাছে যখন গল্প শুনি, আমার কাছে সবসময় মনে হয়েছে যে কী করে মানুষ এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে! আমার আব্বা যুদ্ধ করতে গিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েছিলেন৷ উনিসহ আরও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে চোখ-হাত বেঁধে ট্রেনে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল৷ একজন একজন করে গুলি করে ট্রেন থেকে ফেলে দেয়া হচ্ছিল৷ যখন ওনাকে গুলি করতে যাবে, ঠিক সেই সময় তিনি ট্রেন থেকে লাফ দেন এবং প্রাণে বেঁচে যান৷ এটা অসাধারণ একটা গল্প৷
আমি যখন কোনো গল্প নিয়ে চিন্তা করি, তখন সেই গল্পের মধ্যে নিজেকে কল্পনা করি৷ আমি ভাবলাম মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি থাকলে কী করতাম? হয় আমি খুবই ভয় পেয়ে যেতাম অথবা আমি কোনো কিছু না করে বড় বড় কথা বলতাম৷ এই যে দু'টো বিষয় আমার মাথায় আসলো এখান থেকে আমার মাথায় দু'টো চরিত্র আসে৷ একটা চরিত্রের নাম ধ্রুব আর একটা চরিত্রের নাম আক্কু৷ (চলচ্চিত্রের গল্পটা সম্পর্কে বিস্তারিত থাকছে অডিওতে)
এই দুই চরিত্র বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হবে এবং চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আমরাও সেটার সাক্ষী হবো৷ আমরা সরাসরি দেখতে পাবো কিংবদন্তি সেই মানুষগুলোকে৷
এখন আমরা চলচ্চিত্র তৈরির জন্য গবেষণা করছি৷ এই যে টাইমলাইনটা, যে রাস্তাটা ধরে এ দুই চরিত্র হাঁটবে, যে ঘটনাগুলো তারা দেখবে, সব তো দেখানো সম্ভব না৷ আমি চেষ্টা করছি, যেসব ঐতিহাসিক চরিত্র আগের কোনো চলচ্চিত্রে দেখানো হয়নি, তাদের কথা তুলে ধরতে৷
আপনার বাবা নিশ্চয়ই আপনাকে এ কাজে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন?
আমার বাবা বিষয়টা নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন৷ কারণ তাঁর ধারণা আমি এটা ঠিকমত করতে পারবো না৷ আমি তাঁকে বলেছি, ট্রেন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ার দৃশ্যটা আমি চলচ্চিত্রে রাখবো৷ ‘নদীতে' ঝাঁপ দেয়ার দৃশ্য রাখবো বলতেই বাবা বললেন, সেটা তো নদী ছিল না৷ আমি বললাম, পুরোপুরি বাস্তব ঘটনা তো তুলে ধরা সম্ভব না৷ আমার কাজ নিয়ে তাঁর উদ্বেগ থাকলেও আমি জানি কাজটা শেষ হলে তিনি ভীষণ খুশি হবেন৷
অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র নির্মাণ তো বেশ ব্যয়বহুল, প্রযোজনার ব্যাপারে কারো সাথে কি কথা হয়েছে?
প্রযোজনা নিয়ে এখনও কারও সাথে তেমনভাবে কথা হয়নি, যেটা আসলে একটু চিন্তার বিষয়৷ আমরা যেটা করছি, টিমটা আমাদের মোটামুটি চূড়ান্ত হয়ে গেছে (দলে কে কে আছেন, সে বিষয়ে বিস্তারিত থাকছে অডিওতে)৷ আমি চেষ্টা করছি প্রত্যেকটি ডিপার্টমেন্টের হেড যাতে বাংলাদেশি হয়৷ এখন পর্যন্ত সেভাবেই আমরা এগোচ্ছি৷ আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে কাস্টিং চূড়ান্ত হয়ে যাবে৷ আমাদের টিমটা এরইমধ্যে কাজ শুরু করেছে৷ আমরা এক মিনিটের একটা টিজার ট্রেইলার তৈরি করছি, এটা আমরা আমাদের কাজের মধ্যে থেকে সময় বের করে বাড়তি কাজ করছি৷ এখন পর্যন্ত সবাই সময় দিচ্ছে নিজের আগ্রহ থেকে৷ কারণ আমার যে লক্ষ্য, সেটাতে তাদের বিশ্বাস আছে৷ ট্রেইলারটা তৈরি হওয়ার পর আমরা কিছু কোম্পানির কাছে এটা জমা দেবো৷ এরই মধ্যে কিছু কোম্পানি আগ্রহও দেখিয়েছে৷
একটা অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র নির্মাণ আসলে ভীষণ সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল৷ তাই আমরা প্রথমে একটা শর্টফিল্ম বানাবো৷ শর্টফিল্ম করার কারণ কয়েকটা৷ যেটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ সেটা হচ্ছে, দেখা যে আমরা এটা আসলেই নির্মাণ করতে পারবো কিনা৷ কারণ আমরা একটা নির্দিষ্ট স্টাইলে করছি অ্যানিমেশনটা৷ আমরা একটা লেভেল মেনটেইন করতে চাই৷ লজিস্টিক্যালি আমাদের কোথায় ফোকাস করতে হবে সেটাও দেখার বিষয়৷ আমাদের কোথায় খামতি আছে সেগুলো দেখবো৷ আশা করি এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে শর্ট ফিল্মটা তৈরি করে ফেলবো৷ এটা নিয়ে বিভিন্ন ফেস্টিভেল, ফিল্ম মার্কেটে যাবো৷ আমরা খুব ধীরে ধীরে এগোচ্ছি৷
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বেশ কিছু চলচ্চিত্রে সরকার অনুদান দিয়েছে৷ আপনাদের কি তেমন কোনো পরিকল্পনা আছে?
এখনো পর্যন্ত সরকারের কারো সাথে কথা হয়নি৷ তবে এটা আমরা করবো৷ ফেব্রুয়ারিতে দেশে গিয়ে আমি চেষ্টা করবো যোগাযোগ করতে৷ আমার ইচ্ছে আছে সরকারের কাছে অনুদানের জন্য আবেদন করা৷ আমাদের যে বাজেট, তাতে সরকারের অনুদানেই হয়ে যাবে৷ আমরা আসলে খুব বেশি বাজেট চাচ্ছি না৷ সবাই খুব কম পারিশ্রমিকে কাজটা করছে৷ আমি সরকারের সম্পৃক্ততা চাচ্ছি আরও একটা কারণে৷ বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে শর্টফিল্ম ক্যাটাগরিতে কখনো অস্কারের জন্য ফিল্ম পাঠানো হয়নি৷ আমার মনে হয় আমরা যদি একটা ভালো শর্ট ফিল্ম করতে পারি, তাহলে এটা অস্কারে পাঠানো যেতে পারে৷ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বা তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় বা মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমি এ বিষয়ে কথা বলবো৷
ওয়াহিদ ইবনে রেজা এখন আছেন ক্যানাডার ভ্যানকুভারে৷ বর্তমানে তিনি সনি পিকচার্সের হয়ে অ্যাসোসিয়েট প্রোডাকশন ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করছেন৷ তিনি ব্যাটম্যান ভার্সেস সুপারম্যান: ডন অফ জাস্টিস, ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকা: সিভিল ওয়ার ও ডক্টর স্ট্রেঞ্জ-এর মতো বড় সব হলিউড ছবির কারিগরি দলে ছিলেন৷
সাক্ষাৎকারের বিষয়ে আপনার কোনো মতামত থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷