ঐক্যবদ্ধ শাহবাগ
২২ মার্চ ২০১৩খুলনার বাসিন্দা হালিমা নিজের বক্তব্যে সবাইকে জানাতে, গণজাগরণের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে এসেছেন শাহবাগে৷ তাঁর কথায়, ‘‘ধর্ম, বর্ণ, সংস্কৃতি নির্বিশেষে সব বয়সের মানুষ এখানে একত্র হয়েছে৷ আমার এরকম শান্তপূর্ণ গণজাগরণ স্বাধীনতার আগে আর দেখেনি৷''
শাহবাগ গণজাগরণে অংশ নেওয়াদের অধিকাংশই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি৷ বয়সে তারা তরুণ, অনেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী৷ তবে এই সংগ্রামীরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত৷ তাদের পূর্বপুরুষরা একাত্তরে দখলদার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে হটিয়ে দেশ স্বাধীন করেছেন৷ সেসময় অকাতরে প্রাণ দিয়েছেন অগুনতি মুক্তিযোদ্ধা, সম্ভ্রম হারিয়েছেন লাখো নারী৷ সেই স্বাধীনতার গর্বে গর্বিত বর্তমান প্রজন্মই শাহবাগের মূল চালিকা শক্তি৷
শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ ঘিরে গড়ে ওটা জনসমুদ্রের ঠিক উপরেই ঝুলছে ব্যানার৷ লেখা রয়েছে, ‘যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই'৷ এই যুদ্ধাপরাধের মূল অভিযোগ বাংলাদেশের বৃহত্তম ইসলামপন্থি বিরোধী দল জামায়াত-ই-ইসলামীর বিরুদ্ধে৷ ১৯৭১ সালে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তার অভিযোগে দলটির শীর্ষ নেতাদের বিচার চলছে এখন৷
শাহবাগে অবস্থান নেওয়া এক শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কন্যা চৈতি মজুমদার বলেন, ‘‘একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্যে প্রাণ দিয়েছেন হাজার হাজার মুক্তিসেনা৷ আমরা তাদের সেই লক্ষ্য পূরণ করতে চাই৷''
যেভাবে রাজনীতিতে ফিরেছিল জামায়াত
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জড়িয়ে আছে জামায়াত-ই-ইসলামী৷ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর জামায়াত নেতারা আবারো মাথাচাড়া দিতে শুরু করে৷
বর্তমানে জামায়াতের মূল রাজনৈতিক মিত্র হচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)৷ এই দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান নিজের অবস্থান শক্ত করতে ১৯৭৫ সালে উগ্র ইসলামপন্থীদের আবারো রাজনীতির মাঠে প্রবেশের সুযোগ করে দেন৷ প্রখ্যাত লেখক এবং মানবাধিকার কর্মী শাহরিয়ার কবির এই বিষয়ে বলেন, ‘‘জেনারেল জিয়া এরকম উগ্রগোষ্ঠীকে কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুযোগ করে দিয়েছিলেন৷ ১৯৭৬ সালে তিনি এক অর্ডিনেন্সে ৬৬টি পাকিস্তানপন্থী ইসলামি দলকে বৈধ করেন৷''
শাহবাগ আন্দোলনের প্রধান মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার মনে করেন, সাধারণ মানুষ এতকাল সঙ্ঘবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াতে পারেনি বলে জঙ্গিবাদকে পরাস্ত করা যায়নি৷ তিনি বলেন, ‘‘কিন্তু এখন আমরা, সাধারণ জনতা আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী৷ আমাদের অহিংস তরুণ শক্তি রয়েছে এবং আমরা একটি নতুন বাংলাদেশ গড়বো৷''
একথা সত্যি, ১৫০ মিলিয়ন জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম এখন এক নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছে৷ এই নতুন দেশ গড়ার চেষ্টা এমন এক সময় শুরু হয়েছে, যখন বাংলাদেশের ৩৫ শতাংশ জনসাধারণ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করছে৷ সে দেশে ২০০০ সালের তুলনায় জীবনযাত্রার খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ৷ পাশাপাশি তরুণ বেকারের সংখ্যা বাড়ছে আর প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পঞ্চম শ্রেণি অবধি পৌঁছানোর আগেই বিদ্যালয় ত্যাগ করেছে৷
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিবি) সহকারী পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘‘দারিদ্র্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও এখনো ৪০ মিলিয়ন মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করছে৷''
এই দরিদ্রতার কারণেই বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ এতকাল রাজনৈতিক ইস্যুতে নীরব থেকেছেন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা৷ তবে শাহবাগ এই নীরবতার ধারা বদলে দিচ্ছে৷ সেখানে আন্দোলনরত একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক পুনম চক্রবর্তী বলেন, ‘‘গণতন্ত্রের নামে গত কয়েক দশক ধরে নোংরা রাজনীতির খেলা দেখতে দেখতে হতাশ সাধারণ জনতা এখন আমাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন৷''
শাহবাগের বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী জানিয়েছেন, বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বিরোধীদের সংসদ বয়কটের সুযোগ রয়েছে, তারা চাইলে সাধারণ জনতার বাড়িঘরে, গাড়িতে আগুন দিতে পারে এবং চাইলে অরাজকতা সৃষ্টি করতে পারে৷ এরকম রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপর তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষ৷ অনেকে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিতে বিভক্ত সমাজ নিয়ে হতাশ৷
চক্রবর্তী বলেন, ‘‘এখানে (শাহবাগ) যারা অবস্থান করছেন, তারা ভোটের মাধ্যমে আগামীর রাষ্ট্র শাসকদের নির্ধারণ করবেন৷ ফলে শাহবাগ বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে৷''
পশ্চিমা গণমাধ্যমের একটি বড় অংশ শাহবাগের এই আন্দোলনকে এড়িয়ে গেলেও বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা সেটা পারেননি৷ বরং তাদেরকে শাহবাগের দাবির দিকে মনোযোগী হতে হচ্ছে এবং তারা এই আন্দোলনের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থানও নিচ্ছেন৷ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ঝর্না রানি দাস বলেন, ‘‘ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দলের অনেক রাজনীতিবিদ আমাদের নির্ভেজাল শক্তি দেখে উদ্বিগ্ন হয়েছেন, অনেকে ইতোমধ্যে আমাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন৷''
দাস জানান, আমাদের আন্দোলন যত গতি পাচ্ছে, গতানুগতিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ভাঙ্গনও তত প্রকট হচ্ছে৷ পরিবর্তনটা এভাবেই হবে৷
এআই / এসবি (আইপিএস)