মুম্বই হামলার পাঁচ বছর
২৬ নভেম্বর ২০১৩২০০৮ সালের ২৬শে নভেম্বর৷ দিনটি আর পাঁচটা দিনের মতোই শুরু হয়েছিল৷ সন্ধ্যায় অসংখ্য মানুষ ঘরে ফিরছিলেন৷ শহরের কেন্দ্রস্থলে হোটেলে-রেস্তোরাঁয় দেশি-বিদেশি মানুষের ভিড়৷ তারপর শুরু হলো সেই ভয়ংকর ঘটনা, যা ‘২৬/১১' হিসেবে সারা ভারতে স্মরণীয় হয়ে থাকবে৷ জঙ্গি ইসলামপন্থি সন্ত্রাসবাদীরা গুলি চালিয়ে, বোমা ও গ্রেনেড নিক্ষেপ করে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করেছে৷ বিশেষ করে ইহুদি, অ্যামেরিকান বা ব্রিটিশ হিসেবে তারা যাদের চিহ্নিত করতে পেরেছে, তারাই হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছে৷ সন্ত্রাসীরা হোটেল-রেস্তোরাঁয় মানুষকে পণবন্দি করেছে৷ এক ইহুদি স্থাপনার উপর হামলা চালিয়েছে৷
ভারতের সংবাদমাধ্যম কোনো রাখঢাক না করেই গোটা ঘটনার খুঁটিনাটি ছবি তুলে ধরেছে৷ মৃতদেহ ও মৃতপ্রায় মানুষদেরও দেখানো হয়েছে৷ সন্ত্রাসবাদী ও নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ গড়িয়েছে ২৯শে নভেম্বর পর্যন্ত৷ শেষ পর্যন্ত ন'জন সন্ত্রাসবাদী প্রাণ হারিয়েছে৷ আজমল কাসাভ নামের এক পাকিস্তানি সন্ত্রাসবাদীকে কাবু করে আটক করা সম্ভব হয়েছে৷ মৃতের সংখ্যা ১৬৬, যাদের মধ্যে ভারতীয়দের সংখ্যাই বেশি৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর সূত্র অনুযায়ী আহতের সংখ্যা প্রায় ৩০০৷
ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ
হামলার কিছু পরে পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষ কয়েকজন সন্দেহভাজন লোককে গ্রেপ্তার করে৷ পাঁচ বছর পর তারা আজও বন্দি রয়েছে৷ প্রমাণের অভাবের কারণেই নাকি তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা যাচ্ছে না৷ সন্ত্রাসবাদীদের লক্ষ্যবস্তু সম্পর্কে আগাম খবর সংগ্রহ করার দায়ে মার্কিন নাগরিক ডেভিড কোলম্যান হেডলিকে শিকাগোর এক আদালত ৩৫ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে৷ ভারতের এক আদালত আজমল কাসাভ-এর বিরুদ্ধে ‘ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ'-এর দায়ে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছে৷ ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়৷
হামলার পাঁচ বছর পর ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তদন্তকারীরা এই হামলার প্রেক্ষাপট প্রায় পুরোটাই উন্মোচন করেছেন৷ বিশেষ করে হেডলি ও কাসাভের স্বীকারোক্তি থেকে অনেক কথা জানা গেছে৷ সেই সব তথ্য অনুযায়ী, এই হামলার জন্য লাহোর-ভিত্তিক সংগঠন ‘লস্কর-ই-তৈবা' দায়ী৷ জঙ্গি ইসলামপন্থি এই সংগঠন পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলে৷ ‘নন-স্টেট অ্যাক্টর' হিসেবে তারা ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে নিয়মিত হামলা চালায়৷ ২০০১ সালে মার্কিন প্রশাসন ‘লস্কর-ই-তৈবা'-কে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করে৷
তদন্তে পাকিস্তানের আগ্রহ নেই
আজ পর্যন্ত পাকিস্তান এই হামলার তদন্তের ক্ষেত্রে কোনো উদ্যোগ দেখায়নি৷ ইতিহাসবিদ আরশাদ মাহমুদ ডয়চে ভেলেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এই মনোভাবের ব্যাখ্যা দিয়েছেন৷ পাকিস্তানের সরকারের দাবি, সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ভারত তেমন কোনো জোরালো প্রমাণ দিতে পারেনি৷ মামলার ফলে যদি প্রমাণ হয়ে যায় যে পাকিস্তান মুম্বই হামলায় জড়িত ছিল, তাহলে বিষয়টা সে দেশের পক্ষে বড় অপমানজনক হবে৷ পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিস্ট তৌকির গিলানি অবশ্য মনে করেন, বিষয়টি শুধু দেশের মুখরক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই৷ তাঁর মতে, ‘লস্কর-ই-তৈবা'-র মতো সংগঠনকে মদত দেয় আইএসআই৷ তাই লস্করের বিরুদ্ধে কিছু করা মানে রাষ্ট্রের একটা অংশের উপর হামলা চালানোর মতো৷
মুম্বই হামলার পাঁচ বছর পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংলাপে তেমন কোনো অগ্রগতি ঘটেনি৷ ভারতের ‘হিন্দুস্তান টাইমস' সংবাদপত্রের সাংবাদিক বিনোদ শর্মা মনে করেন, ২৬/১১ ছিল বিশাল এক ব্যর্থতা৷ যখন জানা গেল যে, পাকিস্তান এই হামলার নেপথ্য নায়কদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেবে না, তখন সে দেশের বিরুদ্ধে আস্থা আরও কমে গেল৷
দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে কঠিন সংলাপ
বিনোদ শর্মার মতে, শীতল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্য দুই দেশের সংবাদ মাধ্যমও আংশিকভাবে দায়ী৷ ভারতে পাকিস্তানকে দায়ী করা ও পাকিস্তানে ভারতকে দায়ী করা দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ ফলে কেউই লাভবান হয় না৷ তাঁর মতে, রাজনীতি সংলাপের উপর দাঁড়িয়ে থাকে৷
তবে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিনোদ শর্মা আশাবাদী৷ পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার অঙ্গীকার করেছেন৷ ভারতের কাছে এটা খুবই ইতিবাচক বার্তা৷ কিন্তু প্রশ্ন হলো, তিনি এমনটা করে দেখাতে পারবেন কিনা৷ পর্যবেক্ষকদের মতে, কাজটা বড়ই কঠিন৷ কারণ চরমপন্থিদের প্রতি সমর্থন শরিফের নিজস্ব মুসলিম লিগ দলের ভেতরেও দেখা যায়৷
সম্পর্কের উন্নয়ন ভারতের উপরেও নির্ভর করছে৷ ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সে দেশে সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা৷ তারপর পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়নের সম্ভাবনা বাড়বে কিনা, তা কেউ জানে না৷ বর্তমান কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট সরকার জনমত সমীক্ষায় বিজেপি-র নেতৃত্বে এনডিএ জোটের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে৷ এই পরিস্থিতিতে বর্তমান সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে সংলাপের কোনো উদ্যোগ নিতে পারবে না৷