মুসলিমদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসে কি কিছুই যায় আসে না?
৯ এপ্রিল ২০১৯সেদিন সন্ধ্যায় আমি নিউজিল্যান্ডের দূতাবাসের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম৷ আমি ছাড়া আর মাত্র দুই ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত ছিলেন৷ সত্যি বলতে কি, তখন মনে আতঙ্ক জেগেছিল৷ তখন থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভেবে চলেছি৷ বেশ কয়েকটি প্রশ্ন আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে৷ যারা নিউজিল্যান্ডে হামলার শিকার হয়েছেন, তাদের প্রতি জার্মানির মানুষের সহমর্মিতা এত কম কেন? তাদের প্রতি কোনো বড় মাত্রায় সংহতি দেখা যাচ্ছে না কেন? জার্মান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হর্স্ট সেহোফার বলে থাকেন, যে ইসলাম ধর্ম জার্মানির অংশ নয়৷ সেটাই কি তাহলে সত্যি? অন্য কোনোভাবে আমি এমন পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দিতে পারছি না৷
নিউজিল্যান্ডে যারা হামলার শিকার হয়েছেন, তাঁরা যদি মুসলিম না হয়ে আততায়ী মুসলিম হতো, তাহলে কি সংবাদমাধ্যম অন্যভাবে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতো? এমন প্রশ্ন আরব বিশ্ব ও জার্মানিতে মুসলিমদের মনে জাগছে৷ সম্ভাব্য আততায়ীকে সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দিতে অনেকেই ইতস্তত করছেন কেন? মনে হচ্ছে, নির্দিষ্ট একটি ধর্মীয় পরিচয় থাকলে তবেই যেন তাদের সন্ত্রাসবাদী বলা চলে৷ এই সন্ত্রাসী হামলায় ঠিক বিপরীতটাই ঘটেছে৷ এ ক্ষেত্রে মুসলিমরাই হামলার শিকার হয়েছে৷ সন্দেহভাজন আততায়ী কিন্তু মুসলিম নয়৷
প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার পর সেই অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে আন্তর্জাতিক স্তরের রাজনৈতিক নেতারা যেভাবে সংহতি দেখাতে পথে নেমেছিলেন, এ ক্ষেত্রে তেমনটা দেখা যাচ্ছে না কেন? আমার ‘শাবাবটক' অনুষ্ঠানে নিউজিল্যান্ডে হামলার বিষয়টি নিয়ে আলোচনার প্রস্তুতির সময় অনেক মুসলিম দর্শক ও ইউজার আমাকে এমন সব প্রশ্ন পাঠিয়েছিলেন৷ তখন আমি নিজেকে প্রশ্ন করেছিলাম, জার্মানিতেও কি আমরা আরব বিশ্বের মানুষের চিন্তাধারার কাঠামোয় আটকে পড়ছি? হামলার শিকার যদি অ-মুসলিম হয়, তখন সেখানে কেউ তেমন সোচ্চার হয় না৷ সংহতিবোধও চোখে পড়ে না৷
নিউজিল্যান্ডের ঘটনায় সন্ত্রাসবাদী মুসলিম হলে গোটা ইসলাম ধর্ম আবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসে পড়তো৷ এ ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদী এক শ্বেতাঙ্গ পুরুষ এবং কোনো নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে এই ঘটনার জন্য দায়ী করা হচ্ছে না৷ বরং হামলাকারীকে বিচ্ছিন্ন আততায়ী হিসেবে দেখা হচ্ছে৷ বিচ্ছিন্ন এক হামলাকে কখন একটা গোটা সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত করা হয়? আর কখনই বা বিষয়টির কোনো ভূমিকা থাকে না? ক্রাইস্টচার্চের ঘটনার ক্ষেত্রে কেউ কোনো নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে এই হামলার নিন্দা করার ডাক দিচ্ছে না৷ বিমানবন্দরে এবার শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের মনে আরও কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যাবার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে না৷
জার্মানিতে মুসলিমদের মনে ভয়
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক গবেষণায় একটি বিষয় উঠে এসেছে৷ অপরাধী মুসলিম হলে মার্কিন সংবাদমাধ্যমে সেই ঘটনা আরও বেশি গুরুত্ব পায়৷ অথচ সে দেশে উগ্র দক্ষিণপন্থিরা অনেক বেশি হামলা চালায়৷ মুসলিম আততায়ীর ক্ষেত্রে সংবাদ পরিবেশনের হার অ-মুসলিম আততায়ীর তুলনায় ৪৪৯ শতাংশ বেশি৷ জার্মানিতেও এমনটা ঘটে কিনা, তা জানতে কোনো গবেষণা হয়নি৷
হামলার মাত্র দুই দিন পরও জার্মানির সংবাদমাধ্যমের একাংশে বিষয়টি নিয়ে কোনো শিরোনাম দেখা যায়নি৷ অনেক খোঁজ করলে ওয়েবসাইটের নীচের দিকে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে৷ কোথায় ছিল সব টকশো-গুলি?
জার্মানিতে প্রায় ৫০ লক্ষ মুসলিম বসবাস করেন৷ সম্প্রতি এক শুক্রবার আমি এক মসজিদে গিয়ে মুসলিমদের নিউজিল্যান্ডের হামলা সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলাম৷ সেখানকার মানুষ আমাকে বলেন, যে তাঁদের মনে ভয় রয়েছে৷ তাঁরা নিরাপদ বোধ করছেন না৷ পুলিশের খাতায় প্রতি বছর শ'য়ে শ'য়ে মুসলিম-বিরোধী অপরাধ নথিভুক্ত হচ্ছে৷ ড্রেসডেন শহরে এমনকি একটি মসজিদের উপর বিস্ফোরক দিয়ে হামলা হয়েছে৷ প্রাথমিক সরকারি সূত্র অনুযায়ী ২০১৮ সালের প্রথম ৯ মাসেই মোট ৫৭৮টি ইসলাম-বিরোধী হামলা নথিভুক্ত হয়েছে৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হামলাকারীরা উগ্র দক্ষিণপন্থি৷
সন্ত্রাসবাদ কোনো ধর্ম চেনে না
হিজাব পরা এক নারী আমাকে বলেছেন, ‘‘এমন হামলা জার্মানিতেও ঘটতে পারে বলে আমার ভয় করছে৷'' এমন ভয় আজ আর তাঁর একার মনে নেই৷ আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, যে ২০০৯ সালে ড্রেসডেন শহরে এক আদালত কক্ষে মিশরীয় বংশোদ্ভূত নারী মারওয়া শেরবিনিকে ছুরি চালিয়ে হত্যা করেছিল এক উগ্র দক্ষিণপন্থি ব্যক্তি৷
আমি যে মসজিদে গিয়েছিলাম, জার্মানির অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা তার উপর নজর রাখছে৷ এই মনোভাবের মধ্যেই এক দুষ্টচক্র লুকিয়ে রয়েছে৷ বার বার আমি শুনতে পাই, ‘‘মুসলিমরা তো নিজেরাই দায়ী৷ তাদের ধর্ম বিপদ ও নিপীড়নের পক্ষে এবং গণতন্ত্রের সঙ্গে তার কোনো সঙ্গতি নেই৷'' আমি নিজেই সবার আগে ইসলাম ধর্মের সমালোচনার পক্ষে সওয়াল করি৷ কিন্তু নিউজিল্যান্ডে যে সব মুসলিম এই হামলার শিকার হয়েছেন, তাঁদের প্রতি আমাদের সহানুভূতি দেখানো উচিত৷
ক্রাইস্টচার্চ শহরে প্রার্থনা করার সময় মানুষগুলিকে হত্যা করা হয়৷ তাঁরা সম্পূর্ণ নির্দোষ ছিলেন৷ ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ধর্মবিশ্বাস এমন এক মানবাধিকার, যার প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো উচিত, রক্ষা করা উচিত৷ পশ্চিমা বিশ্বের সব সংবিধানে তা স্বীকৃত অধিকার৷ ইসলাম ধর্মের সমালোচনা ও ইসলাম বিদ্বেষের মধ্যে পার্থক্য করতে হবে৷ কারণ এই সব মুসলিম ব়্যাডিকাল বা মৌলবাদী ইসলামের প্রতিনিধি নন৷ ঠিক যেভাবে ইউরোপীয়রা সন্দেহভাজন হত্যাকারীর চরম দক্ষিণপন্থি ভাবধারার প্রতিনিধি নন৷
আমি এখনো ব্যাখ্যা খুঁজে চলেছি৷ এমনটা হতে পারে কি, যে নিউজিল্যান্ড বহু দূরের এক দেশ হওয়ায় আমরা সেখানে যারা হামলার শিকার হয়েছে, তাদের প্রতি একাত্ম বোধ করছি না? ঘটনাটি জার্মানি অথবা ইউরোপের মাটিতে ঘটলে কি পরিস্থিতি অন্যরকম হতো? কারণ আমরা নিজেদের জার্মান অথবা ইউরোপীয় হিসেবে আরও বেশি পরিচয় দেই? কিন্তু মানুষ তো সর্বত্র মানুষ – তাদের ধর্ম, বর্ণ বা জাতি যাই হোক না কেন!
হ্যাঁ, এবার উগ্রপন্থি মুসলিমরাও কোনো একদিন আবার সন্ত্রাসী হামলা চালাবে, এমন আশঙ্কা অবশ্যই রয়েছে৷ সে ক্ষেত্রেও আমরা সংহতি দেখাতে চাই, দেখানো উচিত৷ সন্ত্রাস কোনো ধর্মের ধার ধারে না৷
জাফর আবদুল করিম/এসবি
জাফর আবদুল করিম (৩৭) ডয়চে ভেলের তরুণদের জন্য আরবি ভাষার অনুষ্ঠান ‘শাবাবটক'-এর বিভাগীয় প্রধান ও উপস্থাপক৷ সমাজের নানা বিতর্কিত বিষয় নিয়ে সমালোচনামূলক আলোচনার কারণে অনুষ্ঠানটি উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে৷ জাফর লাইবেরিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন৷ তাঁরা বাবা-মা লেবানিজ বংশোদ্ভূত৷ লাইবেরিয়া ও সুইজারল্যান্ডে বড় হয়ে ওঠেন জাফর৷ উচ্চশিক্ষার জন্য ড্রেসডেন, লিয়ঁ, লন্ডন ও বার্লিনে সময় কাটিয়েছেন৷ বর্তমানে তিনি বার্লিনে বসবাস করছেন৷ সংবাদপত্রে তাঁর কলামের শিরোনাম ‘জাফার, শু ফি?' – আরবি ভাষায় যার অর্থ ‘জাফর, কী চলবে?'
জাফর আবদুল করিমের ব্লগ পোস্টটি আপনার কেমন লাগলো? জানান নীচের ঘরে৷