মৃত ও গুম হওয়া ব্যক্তির সাজা নিয়ে প্রশ্ন
২৪ নভেম্বর ২০২৩এমন ক্ষেত্রে রায় সংশোধনের কথা বলছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা৷ তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে এমন হয়েছে, নাকি এটি স্বাভাবিক বিচারের প্রক্রিয়ায়ও হতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘১৭ কোটি মানুষের দেশে ১৭শ' বিচারক দিয়ে সুচারুভাবে বিচার কাজ পরিচালনা অসম্ভব৷ এটা সত্যি যে, বেশ কিছু মামলা দ্রুত গতিতে নিষ্পত্তি করে সাজা দেওয়া হচ্ছে৷ অল্প সময়ে দ্রুতগতিতে অনেকগুলো মামলার নিষ্পত্তি করতে গিয়ে বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতা ফুটে উঠছে৷ হঠাৎ করে এই মামলাগুলো বিচার করে দ্রুত সাজা দেওয়ায় জনমনে বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতার বিষয়ে সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে৷ বিচার বিভাগের উপর মানুষের যে আস্থা, এটা তার সহায়ক না৷ এটা সত্যি যে, এতগুলো মামলা দ্রুত বিচার করার ফলে জনমনে কিছুটা সন্দেহ বা আশঙ্কার তৈরি হয়েছে এটা স্বীকার করতে হবে৷”
গত সোমবার নাশকতার অভিযোগে রাজধানীর নিউমার্কেট থানার একটি মামলায় মৃত বিএনপি নেতা মো. আবু তাহের দাইয়াকে সাজা দিয়েছেন আদালত৷ তিনি চার বছর আগে নিউমার্কেট থানার ১৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক থাকাকালীন মারা গেছেন৷ ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে বিএনপির হরতাল-অবরোধ চলাকালে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করার ঘটনার মামলায় নিউমার্কেট থানায় মামলা হয়৷ সেই মামলায় এজাহারনামীয় সাত নম্বর আসামি ছিলেন আবু তাহের৷ মামলার তদন্ত শেষে ওই বছরের ২১ জুলাই আদালতে চার্জশিট দেয় পুলিশ৷ এ মামলার বিচার শেষে আবু তাহের, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল, তথ্যবিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলালসহ ১৪ জনকে দেড় বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত৷ ঢাকা মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আতাউল্লাহ এ রায় ঘোষণা করেন৷
মৃত ব্যক্তিকে সাজা দেওয়ায় তার পরিবার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন৷ মৃত তাহেরের ছেলে মো. এহসান বলেন, ‘‘আমার বাবা রাজনীতি করতেন৷ তিনি চার বছর আগে মারা গেছেন৷ মৃত বাবাকে আদালত সাজা দিয়েছেন- এটা শুনে খারাপ লাগলো৷ একজন মৃত ব্যক্তিকে কীভাবে আদালত সাজা দেয় আমার জানা নেই৷ এটা আমাদের মর্মাহত করেছে৷”
২০১৩ সালের ডিসেম্বরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে সাদা পোশাকে তুলে নেওয়ার পর থেকে নিখোঁজ শাহীনবাগের বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমন৷ তাকে গাড়িতে আগুন দেওয়ার মামলায় আড়াই বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত৷ গত সোমবার ঢাকার চিফ মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত (সিএমএম)-এর ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ শেখ সাদী এই রায় দেন৷ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেছেন আসামিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে৷
সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন সানজিদা ইসলাম তুলি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘২০১৩ সালের ডিসেম্বরে আমার ভাইকে তুলে নেওয়া হয়৷ তিনি মামলার আসামি হলে তদন্ত করে তাকে খুঁজে বের করুক৷ ১০ বছর ধরে যার খবরই পাচ্ছি না তাকে কীভাবে সাজা দেয়? আমার ভাইকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে প্রত্যক্ষদর্শীদের সামনে তুলে নেওয়া হয়েছে৷ তিনি কোনো মামলায় আসামি হলে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করা হোক৷ আমার ভাইয়ের সন্ধানের জন্য আমি উচ্চ আদালতে গেছি৷ জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো তাকে নিয়ে একাধিকবার বিবৃতি দিয়েছে৷ দেশের প্রতিটি মানুষ জানেন সুমনকে গুম করা হয়েছে৷ এরপরও তাকে সাজা দেওয়া হলো! এই মামলার বিষয়ে পুলিশ আমাদের কিছুই বলেনি৷ এমনকি আদালত থেকেও আমরা কোনো ধরনের নোটিশ পাইনি৷”
ভাই নিখোঁজের পর থেকে সানজিদা ইসলাম তুলি ‘মায়ের ডাক’ নামে একটি সংগঠনের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছেন৷ গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এ সংগঠন গড়ে তোলেন তিনি৷
গত ২০ নভেম্বর ঢাকা মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আতাউল্লাহ পুরান ঢাকার চকবাজারের একটি মামলারও রায় দেন৷ সেখানে তিনি ১৬ জন আসামির মধ্যে ১৫ জনকে দুই বছর তিন মাসের কারাদণ্ড দেন৷ এই মামলায়ও মৃত ব্যক্তিকে সাজা দেওয়ার বিষয়টি সামনে এসেছে৷ এই মামলার আসামি পক্ষের আইনজীবী নাহিদুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘৩১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার আজিজুল্লাহকে এক নম্বর আসামি করে পুলিশ মামলাটির চার্জশিট দাখিল করে ২০১৮ সালে৷ অথচ আজিজুল্লাহ মারা গেছেন ২০১৬ সালে৷ শুনানিকালে আমরা বিষয়টি সামনে এনেছি৷ এদিকে মামলা চলাকালে ১৩ নম্বর আসামি মাকসুদুল আলম মারা যান৷ তার ডেথ সার্টিফিকেট আমরা জমা দিয়েছি৷ ১৬ জন আসামির মধ্যে একজন তো ঘটনার দুই বছর আগেই মারা গেছেন, আরেকজন মামলা চলাকালে মারা গেছেন৷ অর্থাৎ, আসামি ১৪ জন হওয়ার কথা৷ কিন্তু রায়ে ১৫ জন আসামিকে সাজা দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ, মৃত একজন সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন৷ আমরা এখনও রায়ের কপি পাইনি৷ পেলে বুঝতে পারবো সেই মৃত ব্যক্তি আজিজুল্লাহ না মাকসুদুল আলম৷”
নাশকতাসহ নানা অভিযোগে সম্প্রতি বিএনপির নেতা-কর্মীদের সাজা দেওয়ার ঘটনাকে ‘পূর্ব পরিকল্পিত’ বলে আখ্যায়িত করেছে বিএনপি৷ তারা বলছে, আসছে নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যই নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে এই সাজার রায় দেওয়া হচ্ছে৷
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে যে রায় এসেছে তা পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যায় যে, মামলাগুলো রাজনৈতিক বিবেচনায় দায়ের করা হয়েছে এবং এর বিচারও হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য৷ এখানে মূল উদ্দেশ্যই রাজনৈতিক, যাতে করে বিএনপির বিভিন্ন পদের দায়িত্বশীল যারা নেতা-কর্মী আছেন, তারা যেন রাজনৈতিক হয়রানি, রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হন৷” মৃত বা গুম হওয়া ব্যক্তিদের সাজার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‘এতদিন আমরা গায়েবি মামলা দেখেছি, এখন গায়েবি রায় দেখছি৷”
মৃত ব্যক্তির কীভাবে সাজা হয়- জানতে চাইলে পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মামলা চলাকালে কেউ যদি মারা যান তাহলে সেই বিষয়টি আদালতের নজরে আনার দায়িত্ব আসামিপক্ষের আইনজীবীর৷ তারা যদি আদালতের নজরে না আনেন তাহলে আদালত কীভাবে জানবেন তিনি মারা গেছেন? আর গুম বলে যেটা বলা হচ্ছে, কাগজ-পত্রে তো কোথাও এই শব্দ নেই৷ ফলে ওই আসামিকে পলাতক বলে ধরে নিয়েই মামলার কাজ পরিচালনা করা হয়৷ ফলে বিচার প্রক্রিয়ায় কোনো ব্যত্যয় হয়নি৷ কোনো মৃত ব্যক্তির নামে সাজা হয়ে থাকলে আদালত সেটা সংশোধন করে দেবেন৷”