‘মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা বিচারের বিরোধিতা নয়'
৫ নভেম্বর ২০১৪
বাংলাদেশে এখন মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত অভিযুক্তের সংখ্যা ১,১৭২ জন৷ তাদের দেশের বিভিন্ন কারাগারের ‘ডেথ সেলে' বন্দি রাখা হয়েছে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার অপেক্ষায়৷ চলতি বছরে বাংলাদেশে কোনো মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়নি৷ তবে আগস্টেই সাতজনের মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে৷ এছাড়া অক্টোবর এবং নভেম্বর মাসে যুদ্ধাপরাধের অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে তিন জামায়াত নেতার৷ ২০১৩ সালে ২২০ জনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন আদালত৷
সর্বশেষ জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের ফাঁসির দণ্ড বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত বহাল রাখার পর, মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক বিবৃতিতে এই দণ্ড স্থগিতের আহ্বান জানিয়েছে৷ সংগঠনটি সাজা হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিরেধিতা করে বলেছে যে, মৃত্যুদণ্ড ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে না৷ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির রায়ের পর, ইউরোপীয় ইউনিয়নও এক বিবৃতিতে এ দণ্ডের বিরোধিতা করেছে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের এক বিবৃতিতে বলেছে, যে কোনো অবস্থায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী৷
এর আগেও কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করাসহ জামায়াত নেতাদের প্রতিটি মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর পরই এ দণ্ডের বিরোধিতা করে বিবৃতি দিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ মৃত্যুদণ্ড বিরোধী সংগঠন এবং জোট৷ কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন জাতিসংঘের বিচারক ও আইনজীবীদের স্বাধীনতা বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি গ্যাব্রিয়েলা নল এবং সামারি এক্সিকিউশন বিষয়ক প্রতিনিধি ক্রিস্টোফার হেনস৷
বাংলাদেশে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক সদস্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বিশ্বের সবদেশ থেকে মানবাধিকারের দিক থেকে মৃত্যুদণ্ডের বিলোপ চায়৷ সেজন্যই মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান তাদের৷ এটা বিচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নয়৷''
তিনি বলেন, ‘‘সেই অবস্থানের কারণেই শুধু বাংলাদেশ নয়, যে কোনো দেশে মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে অ্যামনেস্টি অবস্থান নেয়৷'' তাঁর মতে, ‘‘এই অবস্থানটি যদি জানা থাকে তাহলে সবার কাছে স্পষ্ট হবে যে, অ্যামনেস্টি বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে কোনোভাবেই অবস্থান নেয়নি৷ বরং অ্যামনেস্টিও বিচার চায়, কিন্তু মৃত্যুদণ্ড নয়৷''
অধ্যাপক কলিমুল্লাহ বলেন, ‘‘আমি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একজন কর্মী হিসেবে সাধারণভাবে মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী৷ মানবতারিরোধী অপরাধের জন্য প্রয়োজনে ৩০০ বছর বা আরো বেশি কারাদণ্ড দেয়া যেতে পারে৷ কিন্তু মৃত্যুদণ্ড নয়৷ কারণ মৃত্যুদণ্ড মানবাধিকারের লঙ্ঘন৷''
বাংলাদেশে সর্বশেষ ২০১৩ সালে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে৷ ২০১৩ সালে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাসহ দু'জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷ ২০১২ সালে এক, ২০১১ সালে দুই, ২০১০ সালে নয়, ২০০৮ সালে পাঁচ এবং ২০০৭ সালে ছয়জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে৷
২০০৪-২০১৩ পর্যন্ত, অর্থাৎ এই দশ বছরে মৃত্যুদণ্ড বিলোপ করেছে, এমন দেশের সংখ্যা বেড়েছে৷ ২০১৩ সালের শেষে বিশ্বের মোট ৯৮টি দেশ মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার আইন তুলে দিয়েছে৷ দশ বছর আগে ২০০৪ সালে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ ছিল ৮৫টি দেশে৷ এছাড়া কিছু দেশে আইনত মৃত্যুদণ্ড চালু থাকলেও তা কার্যকর করা হয় না৷ এই ধরনের দেশের সংখ্যা ৫২৷ অর্থাত্ মোট ১৪০টি দেশে এখন মৃত্যুদণ্ড হয় আইনত নিষিদ্ধ অথবা নিষিদ্ধ না হলেও মৃত্যুদণ্ড আর কার্যকর করা হয় না৷ বিশ্বের মোট ৫৮টি দেশে এখনো মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে, যাদের অন্যতম বাংলাদেশ৷
তবে মানবাধিকারের প্রবক্তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি স্টেটের মধ্যে ৩২টিতেই এখনো মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে৷ মৃত্যুদণ্ড নেই মাত্র ১২টি স্টেটে৷ চলতি বছরের প্রথম আট মাসেই যুক্তরাষ্ট্রে ২৮ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়৷ শুধু তাই নয়, আরো ১৬ জনকে এই বছরেই মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে৷ ১৯৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুদণ্ড ফিরে আসার পর, এ পর্যন্ত ১,৩৮২ জনের দণ্ড কার্যকর হয়েছে৷ আর যুক্তরাষ্ট্রের শতকরা ৬০ ভাগেরও বেশি নাগরিক হত্যাকাণ্ডের মতো গুরুতর অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের বিধানের পক্ষে৷
২০১৩ সালে বিশ্বের ২২টি দেশে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে মোট ৭৭৮টি৷ চীনকে বাইরে রেখে বিশ্বে যত মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে, তার মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগ কার্যকর করা হয়েছে মাত্র তিনটি দেশে –ইরান, ইরাক এবং সৌদি আরবে৷ চীনের মৃত্যুদণ্ডের হিসাব পাওয়া দুষ্কর৷
বাংলাদেশের মানবাধিকার নেতা নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতাকে এক করে দেখলে চলবে না৷ এ থেকে এই সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না যে, মানবাধিকার সংগঠনগুলো যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরোধিতা করছে বা যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে৷ তারাও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যে মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে তার বিচার চায়৷''
তিনি বলেন, ‘‘তবে শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের যে কোনো দেশে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান৷ কারণ তারা মনে করে, শাস্তি হিসেবে জীবন কেড়ে নেয়া মানবাধিকারের লঙ্ঘন৷ এটাকে তারা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও মনে করে না৷''
নূর খান মনে করেন, ‘‘যত বড় অপরাধীই হোক মৃত্যুদণ্ড তাঁর সর্বোচ্চ শাস্তি নয়৷ বরং তাকে বাঁচিয়ে রেখে শাস্তি দেয়াই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি৷''