মেলা ছাড়া বাণিজ্য চলে না
১৬ অক্টোবর ২০১৭কোলনে আনুগা নাম দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় খাদ্য ও পানীয়ের মেলা হয়ে গেল৷ সেই মেলায় এবার অতিথি দেশ ছিল ভারত৷ ওদিকে ফ্রাংকফুর্টে শেষ হলো আন্তর্জাতিক বইমেলা৷ সেখানে সহযোগী দেশ ছিল ফ্রান্স৷ মনে রাখতে হবে, এই বইমেলাও মূলত একটি বাণিজ্য মেলা, যার প্রথম তিন দিন শুধুমাত্র ‘বাণিজ্যিক অতিথিদের' জন্য, আপামর জনতার জন্য শুধু শেষের দু'টো দিন৷
বাণিজ্য মেলায় প্রধানত সংশ্লিষ্ট শিল্প বা বাণিজ্য পণ্যের পাইকারি কেনাবেচা হয়৷ দূর দূর থেকে প্রদর্শকরা আসেন তাদের পণ্য দেখাতে ও ক্রেতা সংগ্রহ করতে৷ মেলার পর প্রতিবার ঘোষণা করা হয়, কত কোটি ইউরোর কেনাবেচা হয়েছে৷ হাজার হোক, প্রদর্শকরা দেশ-বিদেশ থেকে এসে, স্টল ভাড়া করে, সেখানে পণ্যের নমুনা সাজিয়ে, প্রতিনিধি রেখে তাদের পণ্য বিক্রি করার আয়োজন করেছেন – সব মিলিয়ে যার খরচ কিছু কম নয়! কাজেই শেষমেষ ব্যবসা ভালো না হলে, তারা কি আর আবার মেলায় আসার উৎসাহ পাবেন?
আলব্রেশ্ট ড্যুরার-এর মতো চিত্রকরদের ছবি দেখলেই বোঝা যায়, মধ্যযুগে সব বাজারঘাট বা কেনাবেচার এলাকাই ছিল মেলার মতো৷ মানুষজন পণ্য নিয়ে সেখানে আসত খদ্দের ধরার আশায়; খদ্দেররাও জানতেন, পছন্দের জিনিস পাওয়ার সম্ভাবনা এই বাজার কিংবা মেলাতেই বেশি৷ সে আমলে দূরদূরান্ত থেকে এসে ঘণ্টা দুয়েক পরে গাড়ি নিয়ে তো আর বাড়ি ফেরা যেতো না; কাজেই ঐ বাজারেই খাওয়া-দাওয়া, ভাঁড় কি জাদুকরের খেলা দেখা; মল্লযুদ্ধ কিংবা তীর ছোঁড়ার প্রতিযোগিতা; একটু সন্ধ্যে হলে কোনো সরাইখানায় গিয়ে এক পাত্র – অর্থাৎ মধ্যযুগে কেল্লার মধ্যেই হোক আর নীচের চত্বরেই হোক, প্রায়ই মেলা বা বাজার বসত আর মানুষজন সেখানে গিয়ে বাণিজ্য থেকে বিনোদন, সব কিছু সাঙ্গ করতে পারতেন৷
আর আজ? বিশ্বের মুখ্য বাণিজ্য মেলাগুলির দুই-তৃতীয়াংশের স্থান হল এই জার্মানিতে৷ প্রতিবছর এখানে ১৫০টি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা ও প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়; সেখানে পসরা দেখান প্রায় ১,৭০,০০০ প্রদর্শক আর সেই পসরা দেখতে ও কিনতে আসেন প্রায় এক কোটি দর্শক৷ প্রত্যেক পাঁচজন দর্শক বা অতিথির একজন আসেন বিদেশ, মানে জার্মানির বাইরে থেকে৷ জার্মানির বড় বড় শহর মিলিয়ে মোট ২২টি স্থায়ী মেলা প্রাঙ্গণ রয়েছে, যেখানকার হলগুলিতে ২৭ লাখ বর্গমিটার প্রদর্শনীর জায়গা রয়েছে৷ প্রদর্শক আর দর্শকরা মিলে প্রতিবছর জার্মানির বাণিজ্য মেলাগুলিতে ১,২০০ কোটি ইউরো খরচ করেন; অপরদিকে ট্রেড ফেয়ারগুলির কল্যাণে জার্মানির জিডিপি বাড়ে বছরে ২,৩৫০ কোটি ইউরো৷
মোটর গাড়িতে যেমন পেট্রোল ছাড়া লাগে মোটর অয়েল, সেরকম বিশ্ববাণিজ্য আজ শুধু উদ্ভাবন ও উৎপাদনই নয়, পণ্য প্রদর্শন, পরিবেশন ও সেই পণ্যের ফরমায়েশও বটে – যা ঘটে এই বাণিজ্য মেলাগুলিতে৷ এক কথায়, বাণিজ্য মেলা হল বিশ্ববাণিজ্যের মোটর ওয়েল, বিশেষ করে এই বিশ্বায়িত বিশ্বে৷
বিনোদন, মনোরঞ্জন
সেজন্য জার্মানিতে রয়েছে অ্যামিউজমেন্ট পার্ক বা থিম পার্ক, বিভিন্ন মরশুমে বিভিন্ন শহরের কার্নিভাল, সকলের প্রিয় প্রথাগত বড়দিনের বাজার, অক্টোবরফেস্টের মতো শুধুই মোচ্ছব এবং – ঐ এবংটা আমার বিশেষ প্রিয়: কোনো কেল্লায় কিংবা শহরের প্রাচীন কেন্দ্রে মধ্যযুগীয় বাজার৷ খেয়াল রাখবেন, মধ্যযুগের বাজার নয়, মধ্যযুগীয় বাজার৷ ইউরোপের মানুষ একদিকে যেমন আধুনিক যন্ত্রসভ্যতার কোনো সুযোগসুবিধাই বাদ দেয় না, অপরদিকে তারা তাদের অতীতকেও বাঁচিয়ে রাখতে সচেষ্ট – আমি বলব, অতীত না হলেও অতীতের আমেজ৷
তাই হঠাৎ যখন দেখি কাঠের বা তেরপলের সব দোকান সাজিয়ে সেখানে মধ্যযুগের সাজপোশাক পরে দোকানিরা সুপ্রাচীন হাতের কাজের নমুনা দেখাচ্ছেন ও বিক্রি করছেন; কোথাও হয়তো কামার গরম আগুনে শলাকা ঢুকিয়ে পরে হাতুড়ি পিটিয়ে ফলা তৈরি করছে; কোথাও নানা ধরণের চামড়ার ব্যাগ ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছে; মেলা প্রাঙ্গণের একদিকে মধ্যযুগীয় ‘নাইট'-দের অসিযুদ্ধ চলেছে, এমনকি ঘোড়ার পিঠে চড়ে কাঠের ভোঁতা বর্শা হাতে টুর্নামেন্টও অসম্ভব নয়; কোথাও মধ্যযুগের ‘মিন্স্ট্রেল' বা বাউল তার বীণা বাজিয়ে সে আমলের গান গাইছে আর তারই মধ্যে ধড়াস করে কোথায় যেন তোপ পড়ল, ঢং ঢং করে গির্জার ঘণ্টা বাজতে শুরু করল – তখন যেন আবার সেই হারানো ইউরোপে ফিরে যাই, যেখানে বাজার ছিল মেলা, আর বাণিজ্য ছিল জীবিকা, আর সব কিছুর কেন্দ্রে ছিল ব্যবসা নয়, জীবন, মানুষের জীবন৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷