মোদীর ‘মনের কথা' – রাজনীতির নতুন খেল!
১৯ ডিসেম্বর ২০১৪রাজা-মহারাজারা জনসাধারণের সুখ-দুঃখের কথা জানতে সাধারণ পোশাকে হেঁটে বেড়াতেন, এমন গল্প আমরা বহুবার শুনেছি৷ তবে ভারতের বর্তমান ‘রাজা' মোদী জনসাধারণের ‘ইচ্ছার' কথা জানছেন তাঁদেরই চিঠিতে৷ এখানেই শেষ নয়, সেই সব ইচ্ছে, নিজের ‘মনের কথা' এরপর তিনি সর্ব সমক্ষে তুলে ধরছেন রেডিও-র মাধ্যমে৷
‘স্বচ্ছ ভারত' অভিযানে রাস্তা-ঘাট, পার্ক, পাবলিক টয়লেট ইত্যাদি পরিষ্কারের পর্ব শেষ করার পর, এবার তিনি ডাক দিয়েছেন ‘নেশামুক্ত ভারত' গড়ার আন্দোলনের৷ বলেছেন, ‘‘মাদক সেবন জীবনে অন্ধকার, বিনাশ ও বিপর্যয় ডেকে আনে৷'' তাই নেশা মুক্তি অভিযানে সকলকে এক জোট হয়ে কাজ করার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী৷
সোশ্যাল মিডিয়ায় এ আন্দোলন আরো জোরদার করার ঘোষণা দিয়ে মোদী বলেছেন হ্যাশট্যাগ #ড্রাগফ্রিইন্ডিয়া ব্যবহার করতে৷ প্রধানমন্ত্রীর মনের কথা মন থেকে মুখে উঠে আসতে না আসতেই টুইটার জগতে ঝড় উঠেছে৷
এমনটা অবশ্য ‘স্বচ্ছ ভারত' অভিযানের সময়ও হয়েছিল৷ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, অর্থাৎ তা শিরোধার্য৷ ভারতের সাধারণ মানুষ তো বটেই, আমলা-মন্ত্রী, বলিউডের নামি-দামি অভিনেতা – সকলেই রাস্তায় নেমেছেন৷ এমনকি আহমেদাবাদে একটি সম্মিলিত বিবাহ অনুষ্ঠানেও বর-কনেরা ঝাড়ু হাতে ঘর-বাড়ি পরিষ্কার রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সম্প্রতি৷
এছাড়া খাদ্য সুরক্ষা, জমি অধিগ্রহণ, শ্রম আইন সংশোধন, কর্মসংস্থান, শিক্ষার অধিকার ইত্যাদি প্রকল্প দ্রুত রূপায়ণে ইতিমধ্যেই উদ্যোগী হয়েছে মোদী সরকার৷ হাত দিয়েছে আর্থিক সংস্কার এবং ‘কালো টাকা' পুনরুদ্ধারে৷ বলা বাহুল্য, নরেন্দ্র মোদীর স্পষ্টবাদিতা এবং দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা আজ সর্বত্র সুবিদিত৷ তাই তিনি যখন ভারতবাসীকে পরামর্শ দেন, তখন কারুর মনেই কোনো প্রশ্ন ওঠে না৷ বরং মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর বাণী শোনেন:
- মাদক সেবন এক ধরণের ব্যাধি৷
- চিকিৎসকেরা পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ ব্যবহার করবেন না৷ অনেক সময়ে কাশির ওষুধও নেশার উৎস হয়ে থাকে৷
- বর্তমান প্রতিযোগিতার দৌড়ে বাবা-মা তাদের সন্তানকে সময় দিতে পারেন না৷ তাঁরা কখনই শিশুর পড়াশোনার বাইরে তার মনের কথা শোনেন না৷
- শিশুদের মনের পরিবর্তন একদিনে হয় না৷ ধীরে ধীরে শিশুর মানসিক পরিবর্তন হয়৷ প্রথম ধাপেই যদি অভিভাবক তাঁর সন্তানের দিকে সঠিক নজর দেন, তাহলে তারা জীবনে চলার পথে নেশা বেছে নেবে না৷
- নেশা খারাপ, তবে যারা নেশা করে তারা খারাপ না৷
- স্বামী বিবেকানন্দ যুব সমাজের আদর্শ নিদর্শন৷ তাই তাঁর দেখানো পথে চলুন৷
- মাদক ব্যবসায়ীদের সাহায্য করবেন কেন? প্রশ্ন তুলেছেন মোদী৷
আক্ষরিক অর্থে কথাগুলো ঠিক৷ মাদক বিরোধী অভিযানে ‘হেল্পলাইন' এবং সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার – এ সবের গুরুত্ব আছে৷ এতে জনমানসে সচেতনতা বাড়ে, সন্দেহ নেই৷ এই যেমন তভলিন সিং-এর মতো বিখ্যাত সাংবাদিক যখন #ড্রাগফ্রিইন্ডিয়া ব্যবহার করে টুইট করেন, তখন মানুষ আরো আশ্বস্ত হয়৷
কিন্তু আমার ভয় করে তখনই, যখন এ সবের মধ্যে একটা ‘হিন্দু, হিন্দি, হিন্দুস্থান'-এর গন্ধ পাই৷ যখন দেখি, একটার পর একটা হিন্দু আশ্রম ফাঁক পেয়ে সুযোগ খুঁজছে৷ এই যেমন ‘আশ্রম ব্যাঙ্গালোর' টুইট করেছে:
অর্থাৎ তারা বলছে, ‘আয়ুর্বেদেই সব উত্তর আছে৷ তাই অ্যান্টিবায়োটিক বর্জন করুন৷' অথবা ‘নেশা দূর করতে যোগব্যায়ামের বিকল্প নেই৷ তাই আপনি ‘অমুক' বা ‘তমুক' আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত হন৷'
ভয়টা আরো বেড়ে যায় যখন দেখি রেনু শরাফের মতো সাধারণ একজন মানুষ ‘নেশামুক্ত ভারত' গড়ার আন্দোলনকে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতবর্ষকে তুলনার কাজে ব্যবহার করছেন৷
তখন আমার প্রভাকরণের মতো প্রধানমন্ত্রী মোদীর এই একের পর এক সামাজিক অভিযানকে ‘অসাধারণ সব রাজনৈতিক কৌশল' বলে মনে হয়৷ এটা যেন তাঁর নতুন ‘খেলা'৷
মনে হয়, মানুষের আশা-আকাঙ্খাকে নিজের ‘মনের কথা' বলে তিনি একদিকে যেমন অগুন্তি ভারতবাসীর মন জয় করছেন, তেমন তাঁদেরই অজান্তে খুব ধীর গতিতে তিনি পাল্টে দিতে চাইছেন ভারতীয়দের মনন৷ ভারতের জনমানসে তিনি সঞ্চারিত করছেন হিন্দুত্বের বীজ৷ অথচ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় এসে মোদী কিন্তু একবারও গৌরিক ধ্বজা ওড়াননি৷ বরং মানুষের ইচ্ছে, তাঁদের সমস্যা, আশা-আকাঙ্খাকে গুরুত্ব দিয়ে বুদ্ধিমত্তারই পরিচয় দিয়েছেন৷ তারপরও সন্দেহ যায় না৷ ভুলতে পারি না তাঁর ‘লঙ্কাকাণ্ড’ থুড়ি ‘গুজরাট কাণ্ড'...৷