মোদীর মুখে কেন কবি মনোমোহন বসুর নাম?
৩ ডিসেম্বর ২০২০বিজেপি হিন্দি বলয়ের দল, এই তকমা ঝেড়ে ফেলতে চাইছে মোদী ব্রিগেড৷ বিধানসভা নির্বাচনের দিন এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক জগৎ ঢুকে পড়ছে আলোচনায়৷ বিজেপি আঁকড়ে ধরছে বাংলার মনীষাকে৷ তাদের প্রচারে স্বামী বিবেকানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কিংবা ঋষি অরবিন্দের কথা ঘুরেফিরেই আসে, যাঁদের সঙ্গে অধ্যাত্মবাদ ও হিন্দুত্বকে জুড়ে বাঙালিকে ছুঁতে চায় বিজেপি৷ অমিত শাহরা অন্য রাজ্যের নেতাদের পশ্চিমবঙ্গে এনে সংগঠনের উপর নজরদারির সিদ্ধান্ত যখন নিয়েছেন, যার জেরে ‘বহিরাগত দল’-এর প্রচার আরো জোরালো করছে তৃণমূল, তখন মোদীর মুখে শোনা গেল বাংলা ভাষার ভুলে-যাওয়া এক কবির নাম৷
উনিশ শতকের কবি মনোমোহন বসু ছিলেন কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সমসাময়িক৷ তিনি একাধারে কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার, সাংবাদিক৷ ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ সাংবাদিকতা করেছেন৷ সম্পাদনা করেছেন ‘মধ্যস্থ’ পত্রিকার৷ মনোমোহনের ‘‘দিনের দিন্ সবে দীন’’ কবিতা থেকে গত রবিবার আকাশবাণীর ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে উদ্ধৃতি দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী৷ স্বদেশি শিল্পোদ্যোগের উপর গুরুত্ব দিতে কবিতার লাইন তুলে মোদী বলেছেন— ‘‘ছুঁই সূতো পর্যন্ত আসে তুঙ্গ হতে, দীয়াশলাই কাটি, তাও আসে পোতে/ প্রদীপটি জ্বালিতে, খেতে, শুতে, যেতে, কিছুতেই লোক নয় স্বাধীন!'' অর্থাৎ সূঁচ, সুতো থেকে শুরু করে দেশলাই সবই আসে বিদেশ থেকে৷ প্রদীপ জ্বালানো থেকে জীবনের সর্বত্র বিদেশি পণ্যের উপর নির্ভর করতে হয় পরাধীন ভারতবাসীকে৷
এই কবিতার উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী স্বদেশি পণ্য ব্যবহারের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন৷ কিন্তু, মনোমোহনের উল্লেখের তাৎপর্য শুধু এটুকুই নয় বলে বিশেষজ্ঞদের একাংশের ধারণা৷ কবি ছিলেন ‘হিন্দুমেলা’র সমর্থক৷ তাঁর লেখায় জাতীয়বাদী চেতনা প্রতিফলিত হয়েছিল৷ হিন্দুদের ধর্মীয় রীতিনীতি নিয়ে তিনি নাটকও রচনা করেছিলেন৷ কট্টর জাতীয়তাবাদী বিজেপির মনোমোহনের প্রতি আগ্রহের এটাও বড় কারণ বলে অনেকের মত৷ কবি সুবোধ সরকার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘মনোমোহন বসু হিন্দুমেলার সমর্থক ছিলেন বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় তাঁর উল্লেখ থাকার পিছনে এটি অন্যতম কারণ৷ প্রধানমন্ত্রী কোনো কবির কথা বলতেই পারেন, তবে তাঁর উদ্দেশ্যটাও বিচার করে দেখার প্রয়োজন আছে৷’
তৃণমূল-সহ রাজ্যের বিজেপি বিরোধী দলগুলির দাবি, হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্থানই গেরুয়া শিবিরের মূল স্লোগান৷ তারা ভারতীয় বহুত্ববাদের বিরোধী৷ বাঙালির সঙ্গেও এই দলের কোনো যোগ নেই৷ যদিও বিজেপির রাজ্য কমিটির সদস্য মোহিত রায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘হিন্দুত্বের ধারণা উত্তর ভারত থেকে এসেছে বলে বামপন্থীরা ইতিহাসকে বিকৃত করেছেন৷ অথচ বন্দেমাতরম মন্ত্রের উদ্ভব এই বাংলায়৷ বাঙালির দুর্গোত্সবের সঙ্গে রামচন্দ্রের সম্পর্ক রয়েছে৷ এমনকী হিন্দির আগেও বাংলায় কৃত্তিবাস রামায়ণ অনুবাদ করেছিলেন৷ অতএব বাঙালির সঙ্গে বিজেপির যোগ নেই, এটা অপপ্রচার৷’’
তবে আত্মনির্ভর ভারত গড়ার ক্ষেত্রে মনোমোহনের যে কবিতার লাইন তুলে এনেছেন মোদী, তার এখন প্রাসঙ্গিকতা নেই বলেই মনে করেন সুবোধ সরকার৷ তাঁর বক্তব্য, ‘‘পরাধীন দেশে যে স্বপ্ন ছিল, তার কথা বলেছেন কবি৷ কিন্তু, আজকের ভারতের পরিকাঠামোর সঙ্গে সেই স্বপ্নের মিল নেই৷ আগে সবই বিদেশ থেকে আসত৷ স্বাধীন ভারত ততটা পরনির্ভর নয়৷ বিশ্বায়িত দুনিয়ায় শুধু স্বদেশি পণ্য ব্যবহার করবেন এটা কেউ ভাবতে পারেন না৷’’
‘অবাঙালি দল’-এর তকমা মুছে দিতে বিজেপি জোরদার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ৷ তারা দেড়শো জন বিশিষ্ট বাঙালির তালিকা তৈরি করছে, যাঁদের ভাবনার বড় জায়গা জুড়ে রয়েছে জাতীয়তাবাদ৷ এই মনীষীদের কথা তুলে ধরে রাজ্যে বিভিন্ন শাখা সংগঠনকে দিয়ে প্রচারের পরিকল্পনা রয়েছে অমিত শাহদের৷ লক্ষ্য এক ঢিলে দু'টি পাখি মারা— বাঙালির আরো কাছাকাছি আসার সঙ্গে নির্বাচনের আগে জাতীয়তাবাদী প্রচারকে আরো তীব্র করে তোলা৷