যুক্তরাজ্যের স্বপ্নের বিয়ে, পরিণতি বিচ্ছেদে
৭ জুলাই ২০২১সানা হাফিজ তখন সবে দশম শ্রেনীতে উঠেছে৷ এরিমধ্যে যুক্তরাজ্যে জন্ম তার এক আত্মীয়ের সঙ্গে এল বিয়ের প্রস্তাব৷ সানার স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা শেষে করে সরকারি কর্মকর্তা হবেন, পরিবারের ভাগ্য ফেরাবেন৷ বিয়ের প্রস্তাবে তার মনে হলো যুক্তরাজ্য গিয়েও তিনি পড়াশোনা ও চাকরি করে পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারবেন৷ তাই অভিভাবকদের ইচ্ছায় দ্বীমত করলেন না৷ ছেলের পরিবার থেকে বলা হলো দ্বাদশ ক্লাসের পর আর পড়া যাবে না৷ পরিবারের কথা ভেবে সেটিও মেনে নিলেন৷ এরপর হলো বাগদান, বছর পাঁচেক পরে বিয়ে৷
২০১৮ সালে আগস্টে ধারকর্জ করে ধুমধামের সঙ্গেই মেয়ের বিয়ে দেন সানার বাবা-মা৷ কিছুদিন পর স্বামী ও তাদের পরিবার ফিরে চলে গেল যুক্তরাজ্যে৷ কথা ছিল সানাকেও তারা নিয়ে যাবেন সেখানে৷ এরপর সপ্তাহ, মাস, বছর পেরোয়৷ ‘‘এক বছর আমাদের ভালো যোগাযোগ ছিল এবং ফোনে কথা হতো৷ এরপরই তার আচরণের পরিবর্তন হতে শুরু করল৷ আমি যখন যুক্তরাজ্যে আসার জন্য চাপ দিলাম সে আমাকে নিন্দা ও অপমান করা শুরু করল৷ সেই বছরের আগস্টে ডিভোর্স পাঠাল,’’ অশ্রুসজল চোখে ডয়চে ভেলেকে বলেন সানা৷
সানা ও তার পরিবারের জন্য বিষয়টি আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মতো৷ কেননা এর মধ্যে একে একে আট বছর পেরিয়ে গেছে৷ সরকারি চাকরির স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে পড়াশোনা ছেড়েছে সানা, পরিবারের বেড়েছে ঋণ৷ পুরাতন স্বপ্ন নতুন করে গড়ার আর উপায় নেই তার সামনে তখন৷ ‘‘আমি উচ্চ শিক্ষিত হতে পারতাম, সরকারি চাকরিজীবী হওয়ার সুযোগ থাকত৷ এখন কে আমার এই ক্ষতিপূরণ দেবে?'' এমন প্রশ্ন যে শুধু সানার তা নয়৷ কাশ্মীরের যে মিরপুর জেলায় তিনি বসবাস করেন সেখানকার বহু নারীর চোখে মুখে একই কথা ঘুরে ফিরে৷
১৯৫০-৬০ এর দশকে অঞ্চলটি থেকে বহু মানুষ পাড়ি জমিয়েছেন ব্রিটেনে৷ কেউ বিয়ে করে, কেউ শরণার্থী হিসেবে, কেউবা কাজ ও পারিবারিক সূত্রে৷ এরই মধ্যে তাদের দ্বিতীয় প্রজন্মও ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবে সেখানে বসবাস করছে৷ তাদের বিয়ের জন্য পরিবার আসে পাকিস্তানে৷ সানার মতো দরিদ্র পরিবারের মেয়েদেরই তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বেছে নেন৷ তারপর একই উদাহরণের পুনরাবৃত্তি চলতে থাকে৷ দেশটির নারী অধিকারীকর্মী ঘাজালা হায়দার লোধিও সে কথাই বললেন৷ ‘‘১৯৯০ এর দশক থেকে এরকম কয়েক হাজার ঘটনা আমি শুনেছি ও দেখেছি৷ আমাদের রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থার কারণে এই কথাগুলো মেয়েরা কাউকে জানায় না,’’ বলেন তিনি৷
এমন অনেক ঘটনার সাক্ষী আইনজীবী ইফজাল আহমেদ খানও৷ তিনি ডয়চে ভেলের কাছে তেমনই একটি ঘটনা তুলে ধরেন৷ পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের ভিম্বারে জন্ম নেওয়া এক ব্রিটিশ নাগরিকের সঙ্গে সাত বছর আগে তার এক কাজিনের বিয়ে হয়৷ কয়েক বছর পর তাদের সন্তান হয়৷ এরপর সেই ব্রিটিশ নাগরিক তাদের ফেলে চলে যান৷ পরে তিনি স্ত্রীকে তালাক দেন৷
এত এত ঘটনায় বিয়ে করতে আসা ব্রিটিশ পাকিস্তানিদের নিয়ে দুর্নাম ছড়িয়ে পড়েছে সেখানে৷ লোধি জানান, অর্ধেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় পাত্র আগের বিবাহিত৷ একটি ঘটনায় ছয়বার বিবাহিত একজনের কথাও তিনি জানতে পেরেছেন৷ এই পাত্রদের বয়স হয় ৪০ থেকে ৬০ বছর অবধি৷
কিন্তু একই ঘটনা একের পর এক কেন ঘটছে? মিরপুর জেলায় অধিকারীকর্মী সর্দার আবরার আজাদের মতে মূল কারণটি দারিদ্র্য৷ পাকিস্তানি পরিবার তাদের মেয়েকে ব্রিটিশ বরের কাছে বিয়ে দিয়ে নিশ্চিত হতে চান, তাদের ভাগ্যও ফেরাতে চান৷ এজন্এয তটাই মরিয়া থাকেন যে ছেলের চরিত্র সম্পর্কেও কোন খোঁজ খবর নেন না৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রতারকদের পাল্লায় পড়েন তারা৷ ছেলেরা বিয়ে করে নতুন স্ত্রীর সঙ্গে থাকে, মেয়ের পরিবারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে এক পর্যায়ে সটকে পড়ে৷
আবার অনেক পরিবারের স্বপ্ন থাকে তাদের মেয়েকে পাঠানো গেলে সে তার ভাইকেও যুক্তরাজ্যে নিয়ে যেতে পারবে৷ এতে গোটা পরিবারের ভাগ্যই বদলে যাবে৷ কিন্তু এই ভাবনা তাদের জন্য অচিরেই দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়৷ যারা প্রতারণা করে তারাও জানে ভুক্তভোগীরা আইন আদালতের দ্বারস্থ হবে না৷
এস খান/এফএস
জুনের ছবিঘর দেখুন...