যুদ্ধাপরাধ-পর্ব অবসানে বাংলাদেশের ঝুঁকিপূর্ণ প্রয়াস
৩ নভেম্বর ২০১৪১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যে অপরাধকর্ম হয়েছিল, তা সত্যিকার অর্থেই ছিল বিভৎস৷ বলা হয়ে থাকে তখন ৩০ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন, দু'লক্ষ নারী হয়েছিলেন ধর্ষিত আর অন্তত এক কোটি মানুষ প্রাণ বাঁচানোর জন্য বাধ্য হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন৷ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যু্দ্ধ থামানোর জন্য খুব বেশি কিছু করেনি, তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের বিরুদ্ধে চরমভাবে মানবাধিকার লংঘিত হওয়া সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছিল৷ সেটা যে দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসের সবচেয়ে কালো অধ্যায়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷ অথচ ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার পর একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়া হয়৷ এমন পরিস্থিতিতে যে হতাশা দেখা দেয় তা দূর করা কঠিন৷
বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে৷ শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই যে এর মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই৷ ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগেই তিনি এ আশ্বাস দিয়েছিলেন৷ মানবাধিকারবিরোধী অপরাধ বিচারের আন্তর্জাতিক ট্রাইবুন্যাল ২০১০ সাল থেকে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে অভিযুক্তদের বিচার শুরু করে৷ ট্রাইব্যুনাল এ পর্যন্ত ৮ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে, যার মধ্যে দু'জনকে আবার আপিলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট৷ সাজাপ্রাপ্তদের সমর্থকরা গত কয়েকমাসে বেশ কয়েকবার প্রতিবাদ জানিয়েছে৷ তাদের বিধ্বংসী প্রতিবাদের ফলে সারা দেশে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা দেয়৷ তবে যুদ্ধাপরাধের বিচারের পক্ষের অনেকেই মনে করেন, একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের ফাঁসিতে ঝোলানোটাই হবে ন্যায়বিচার৷
আসলে কী তা হবে? কয়েকদিন আগে আমি বাংলাদেশের এক নাগরিকের সঙ্গে কথা বলছিলাম৷ ট্রাইবুন্যালের কাজ নিয়ে নিজের কিছু সংশয়ের কথা জানাতেই তিনি আমাকে বললেন, ‘‘এ সব কথা লিখলে তুমি আর বাংলাদেশে যেতে পারবে না৷'' শুনে কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলাম৷ তবে তাঁর এ মন্তব্য আমার কাছে বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমান পরিস্থিতিকে আরো ভালো করে বুঝতেও সহায়তা করেছে৷ কয়েক দশক ধরে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হয়েছে৷ যাঁদের বিরুদ্ধে একাত্তরে ব্যাপক যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ রয়েছে, তাঁরা এতদিন ছিলেন সুবিধাভোগী, দেশ শাসনেও ভূমিকা রাখার সুযোগও পেয়েছেন তাঁরা৷ অন্যদিকে এতদিন যাঁরা যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি জানিয়ে এসেছেন, ট্রাইবুন্যাল কাজ শুরু করার পর থেকে তা আদায়ের চেষ্টা চূড়ান্ত রূপ পেয়েছে৷ তাঁদের চিন্তা আবেগ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত৷ তাঁদের কাছে মানবতাবিরোধী অপরাধের শাস্তি শুধুই মৃত্যুদণ্ড, এর কোনো বিকল্প হতে পারে না এবং বিষয়টি বিতর্কের উর্দ্ধে৷ এমন হওয়ার কারণ খুব বোধগম্য৷ কিন্তু তাঁরা আবেগে আবদ্ধ থাকায় দেশও বিপজ্জনক পরিস্তিতির দিকে যাচ্ছে৷
৪০ বছরেরও পর এমন একটি বিচারকাজ পরিচালনা করলে তাতে দোষ-ত্রুটি প্রায় অনিবার্য৷ ঘটনার এতকাল পর সাক্ষ্যগ্রহণ করায় এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে৷ বিবাদিদের পক্ষ থেকে এরকম কথা উঠছে৷ তবে তাতে কেউ কর্ণপাত করছে না৷ অনেক আগে থেকেই জনমত গড়ে উঠেছে৷ তাই তাঁদের কাছে কী প্রত্যাশা করা হচ্ছে, বিচারকরা তা জানেন৷ এমন সমস্যাসংকুল বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলে মানবতাবিরোধী অপরাধের শিকারদের আত্মীয়রা সন্তুষ্ট হতে পারেন, তাঁদের মনে হতে পারে – এতদিনে সুবিচার হয়েছে, তবে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতদের জন্য এটা ভালো কথা নয়৷ মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়ে গেলে তো আর ফেরানো যায় না৷ সংশোধনের কোনো সুযোগই তখন থাকেনা৷
এর ফলে এটা যাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে তাদের সমর্থকদের জন্য নতুন ‘শহিদ' তৈরি করার সুযোগ হয়ে যেতে পারে৷ তারা বিশ্বাস করে, ট্রাইবুন্যাল সত্যিকারের বিচার করছে না বা দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে জঘণ্য অধ্যায়ে যবণিকা টানার চেষ্টা করছে না, ট্রাইবুন্যাল সবকিছুই করছে শেখ হাসিনার প্রতিশোধের ইচ্ছাকে চরিতার্থ করতে৷ এর পরিণামে ডানপন্থি ধর্মাশ্রয়ী দল আর উদারপন্থি ধর্মনিরপেক্ষদের মধ্যে বিভেদটা আরো বড় আকার নিতে পারে৷ এ অবস্থা দেশের গণতন্ত্রের জন্যও হুমকি হতে পারে৷
পশ্চিম ইউরোপে আমরা মনে করি, মুত্যুদণ্ড নিষ্ঠুর এবং অমানবিক শাস্তি৷ নাৎসি যুগে প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার অ্যাডলফ হিটলার এই মৃত্যুদণ্ডকে ব্যবহার করেছিলেন৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ন্যুরেমবার্গ ট্রায়েলে অধিকাংশ নাৎসি নেতাকেও যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল তা-ও সত্য৷ তবে সেটা ছিল ইতিহাসের সম্পূর্ণ অন্যরকম একটা সময়৷ এখন বিশ্বের ১৪০টির মতো দেশ মৃত্যুদণ্ড দেয়া বন্ধ করেছে৷ ২০০৯ সালের পর থেকে বাংলাদেশসহ মাত্র নয়টি দেশে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে৷ চীনে বছরে ২৪শ মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় – এটা ঠিক৷ ওয়াশিংটন একদিকে মানবাধিকার নিয়ে বড় বড় কথা বলে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি দেশে এখনো মৃত্যুদণ্ড দেয়া হচ্ছে – এটাও ঠিক৷ এতকিছুর পরও ইউরোপে আমরা মৃত্যুদণ্ডকে অপছন্দ করি৷
অনেকেই হয়ত বলবেন, দূর থেকে কথা বলা সহজ৷ তবে এইটুকু বলা যেতেই পারে যে, দক্ষিণ আফ্রিকা বর্ণবাদ পরবর্তী সময়ে নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে যেভাবে বিবদমান দু'পক্ষের মধ্যে আপোষরফার একটা পথ ধরে কাজ করে সফল হয়েছে, সেই পন্থা অবলম্বন করলে ‘আন্তর্জাতিক ট্রাইবুন্যাল'-কে ঘিরে বাংলাদেশে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা এড়ানো যেত৷