যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অবশ্যই হবে
২৭ অক্টোবর ২০১১জার্মানিকে ঘিরে স্মৃতি
জার্মানির অনুষঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মনের কোণে এই দেশটির জন্য একটি জায়গা রয়েছে৷ এবং তার কারণ অবোধ্য নয়৷ ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান যখন ঘাতকদের হাতে নৃশংসভাবে নিহত হলেন সপরিবারে, তখন শেখ হাসিনা তাঁর স্বামী পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার গবেষণাকাজের সূত্রে জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন৷ তিনি এবং তাঁর বোন শেখ রেহানা তাই প্রাণে বেঁচে যান৷ জার্মানিতে এলে কি সেই যন্ত্রণাকর স্মৃতি হানা দিতে চায়?
প্রধানমন্ত্রী অকপটে জানালেন, স্বাভাবিকভাবেই সেই স্মৃতি এসে উপস্থিত হয়৷ সেই সময় জার্মানিতেই তাঁরা প্রথম আশ্রয় পেয়েছিলেন৷ ভুলতে পারেননা সেই বেদনাদায়ক মুহূর্তটি যখন হঠাৎ জানতে পারলেন যে তাঁদের আর কেউ নেই৷ বললেন: ‘‘যখনই জার্মানিতে আসি তখনই সেই স্মৃতিগুলো মানসপটে ভেসে আসে৷''
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক
দীর্ঘদিনের বন্ধু দেশ জার্মানির সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার আরো প্রসার ঘটবে এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা আশাবাদী৷ এ নিয়ে চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে৷ তিনি যেভাবে সাহসের সঙ্গে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তার উল্লেখ করতে ভোলেননি জার্মান চ্যান্সেলর তাঁদের যৌথ সংবাদ সম্মেলনে৷ এই সম্পর্কের মূল্যায়ন করতে গিয়ে শেখ হাসিনা স্বীকার করেন যে স্বাধীনতার সূচনা থেকেই যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে, তার উন্নয়ন প্রক্রিয়া জার্মানি সবসময় সাহায্য দিয়ে এসেছে৷ জার্মানির উদার সমর্থন বাংলাদেশ পেয়েছে বলেই তিনি উল্লেখ করেন৷ জার্মান উদ্যোক্তাদের প্রতি বাংলাদেশে আরো বেশি বিনিয়োগের আহ্বান জানান৷ সন্তোষ প্রকাশ করেন এই বলে যে জার্মান উদ্যোক্তারা বাংলাদেশে জাহাজ নির্মাণের নতুন খাতেও বিনিয়োগ করার দিকে ঝুঁকছেন৷ তিনি বলেন, বিদেশি বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত করতে সরকার নানা ব্যবস্থা নিয়েছেন৷
বিরোধী দল প্রসঙ্গে
বিরোধী দলের সংসদ বর্জনের নীতির তীব্র সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী৷ তিনি বলেন, সংসদ বর্জন করার কোন যৌক্তিক কারণ দেখাতে পারছেননা বিরোধী নেত্রী৷ তিনি বলেন, এই বর্জন গণতন্ত্রকে হেয় করারই নামান্তর৷
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ অব্যাহত থাকবে বলেই প্রধানমন্ত্রী হাসিনার দৃঢ় বিশ্বাস৷ তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ তাঁর সরকার শুরু করেছে৷ এটা জাতির দাবি ছিল৷ দাবি ছিল দেশের যুবসমাজের৷ তিনি বলেন: ‘‘বিচার যখন শুরু হয়েছে তা চলতে থাকবে এবং বিচার শেষও হবে৷''
প্রধানমন্ত্রী কড়া ভাষায় অভিযোগ করেন যে বিরোধী দলীয় নেত্রী যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে যাদের, তাদের মুক্তির পক্ষে বক্তব্য রাখছেন৷ এটাকে তিনি দুর্ভাগ্যজনক বলে অভিহিত করেন৷ তিনি বলেন: ‘‘আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে বাংলাদেশের জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে৷ তারা চায় এই অপরাধীদের বিচার হোক৷ এবং ইনশাল্লাহ, বাংলাদেশে এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অবশ্যই হবে৷''
চ্যান্সেলরের সঙ্গে বৈঠক
জার্মানি সফরের শেষ দিনে চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সঙ্গে আলোচনা করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ আলোচনার পর এক যুক্ত সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে তিনি এবারকার সফরকে দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে একটি মাইল স্টোন বলে অভিহিত করেন৷ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ যে-ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছে তা প্রশমিত করা এবং শিক্ষার মত খাতে জার্মানির সহযোগিতা ও সাহায্যের আশ্বাস পেয়েছেন তিনি৷ প্রধানমন্ত্রী জার্মান চ্যান্সেলরকে বাংলাদেশ সফর করারও আমন্ত্রণ জানান৷ চ্যান্সেলর ম্যার্কেল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কথা উল্লেখ করেন৷ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাহসের সঙ্গে যেভাবে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন তিনি তার প্রশংসা করেন৷ বলেন, দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার আরও প্রসার ঘটবে৷
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জার্মানিতে এটা ছিল শেখ হাসিনার তৃতীয় সফর৷ চারদিনের এই সফর ছিল পূর্ণ৷ বার্লিনে বাংলাদেশ দূতাবাসের উদ্যোগে শুরু হওয়া বাংলা স্কুল ‘পাঠশালা’র ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মিলিত হন প্রধানমন্ত্রী৷ প্রবাসী বাংলাদেশীদের এই ছেলেমেয়েরা নাচ ও গানের এক অনুষ্ঠান করে তাঁকে স্বাগত জানান৷ জার্মানিতে জন্ম নিয়েও তারা যেভাবে বাংলা ভাষার চর্চা করছে, লালন করছে বাঙালির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য, তাতে তিনি আনন্দ প্রকাশ করেন৷
ব্যস্ত সফরসূচি
জার্মানিতে প্রবাসী বিশিষ্ট বাংলাদেশীদের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও কথা হয় প্রধানমন্ত্রীর৷ জার্মানিতে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শাখা ইউরোপের অন্যান্য দেশ থেকে আগত প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীকে সম্বর্ধনা জানান৷ তিনি তাঁদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন৷
এই সফরে তিনি বার্লিনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সামিটের উদ্বোধনী দিনে কি-নোট ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী হাসিনা৷ স্বাস্থ্যক্ষেত্রে আগামী দিনগুলোর চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবিলা করতে তিনি স্বাস্থ্য প্রযুক্তি ও গবেষণা, স্বাস্থ্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিকাঠামো, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ ক্ষেত্রে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান জানান৷
তাঁর এই সফরেই বার্লিনে আয়োজিত হয় বাংলাদেশ-জার্মান চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির বিনিয়োগ ফোরামে বক্তব্য রেখেছেন৷ এতে অংশ নেন বাংলাদেশ ও জার্মানির শিল্প ও উদ্যোক্তা মহলের শতাধিক প্রতিনিধি৷
ডয়চে ভেলের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী চলতি নানা বিষয় নিয়ে তাঁর মত প্রকাশ করেন৷ তিস্তা নদীর পানি বণ্টন, প্রবাসীদের দেশে বিনিয়োগের মত বিষয় নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি৷
প্রতিবেদন: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন