যুদ্ধের মধ্যে গোয়েন্দাগিরি ও সংবাদকর্মীর কাজ করেন রাজিয়া
১৩ জুলাই ২০১১ঢাকার ঘোড়াশালে জন্ম রাজিয়া সরকারের৷ পিতা রইসুদ্দিন আহমেদ এবং মাতা জগত বেগম৷ তরুণ বয়স থেকেই বাম আদর্শে উজ্জীবিত রাজিয়া৷ ১৯৬০ সালে বৈবাহিক সূত্রে দিনাজপুর চলে আসেন৷ তবে বিয়ের পরও শুধু ঘর-সংসারের চার সীমানায় আটকে ছিলেন না তিনি৷ ১৯৬২ সাল থেকে ভাসানী ন্যাপ এর সাথে কাজ করেন৷ পরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন৷ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে ঘিরে আন্দোলন-সংগ্রামে সামনের সারিতে ছিলেন৷ এছাড়া পূর্ববাংলা স্বাধীন করার জন্য মাওলানা ভাসানীর ডাক ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, পূর্ববাংলা স্বাধীন করো' এই স্লোগানে সাড়া দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে গেছেন রাজিয়া৷
স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে কালিয়াগঞ্জ অঞ্চলে জুন মাস পর্যন্ত অবস্থান করেন তিনি৷ সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করতেন এই সাহসী নারী৷ মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সংরক্ষণ ও খাবার সরবরাহ করতেন৷ তাঁদের নিরাপদ আশ্রয়ে লুকিয়ে রেখে রাতের আঁধারে ভারতে পাঠাতেন প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য৷ রাজিয়ার এসব কর্মকাণ্ডের কথা জানার পর কেরোসিন ঢেলে তাঁদের বাড়ি পুড়িয়ে দেয় পাক সেনা ও তাদের দোসররা৷ যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশে ফিরে নিজের সাজানো-গোছানো সংসারের কিছুই পাননি রাজিয়া৷ এমনকি বাড়ির দরজা, জানালাও অবশিষ্ট ছিল না৷ ছিল শুধু ছাদ আর মেঝে৷
কালিয়াগঞ্জে কর্মরত অবস্থায় রণকৌশল হিসেবে রাজিয়া এবং তাঁর কলেজ শিক্ষক স্বামী যুদ্ধ পরিস্থিতির মাঝেও গাইবান্ধায় পাড়ি জমান৷ সেখানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কলেজে শিক্ষকতা চালিয়ে যেতে থাকেন রাজিয়ার স্বামী৷ এর পেছনে একমাত্র লক্ষ্য ছিল সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারা যেহেতু শহরে প্রবেশ করতে পারতো না, তাই শিক্ষকের ভূমিকায় শহরে বাস করে পাক সেনাদের গতিবিধি এবং যুদ্ধের পরিস্থিতি সম্পর্কিত তথ্য-উপাত্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সরবরাহ করা৷ একদিকে গোয়েন্দাগিরি এবং অন্যদিকে সংবাদকর্মীর দায়িত্ব পালন করতেন রাজিয়া এবং তাঁর স্বামী৷
এই ভয়ংকর গোপনীয় কাজের কথা ডয়চে ভেলেকে জানালেন রাজিয়া সরকার৷ তিনি বলেন, ‘‘কালিয়াগঞ্জে কাজ করার সময় আমার স্বামীকে তাঁর ছাত্ররা বলল যে, স্যার আপনি যেহেতু রাজনীতিতে প্রকাশ্য ছিলেন না৷ ফলে আপনি গাইবান্ধা শহরে গিয়ে শিক্ষকতা চালিয়ে যান৷ এর ফলে আমরা সেখান থেকে আপনার মাধ্যমে যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় সব খবর পাবো৷ ফলে জুন মাসের শেষের দিকে আমরা সপরিবারে গাইবান্ধা চলে আসি৷ সেখান থেকে প্রতিদিন সারাদিনের খবরা খবর আমরা চিঠিতে কিংবা কোন কাগজের টুকরায় লিখে নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে আসতাম৷ মুক্তিযোদ্ধারা এসে তাদের সুবিধামতো সময়ে তা নিয়ে যেতো৷ আবার তারাও তাদের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো জানার জন্য কাগজে লিখে নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে যেতো, আমরা সেখান থেকে নিয়ে আসতাম এবং সেগুলোর জবাব দিতাম৷''
এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয়মাসের অসংখ্য ঘটনার মধ্য থেকে একটি বিশেষ ঘটনার কথা জানালেন রাজিয়া৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘গাইবান্ধায় আমাদের সামনের বাড়ির একজন ছাত্র কেবল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ শেষ করে আসল৷ কিন্তু এরপরই যুদ্ধ শুরু হলে সে যুদ্ধে চলে যায়৷ এদিকে, সেই বাসার উপর চোখ পড়ে পাক সেনাদের৷ তারা কয়েকদিন সেই বাড়িতে অভিযান চালানোর জন্য আসে৷ আমি বিষয়টি টের পেয়ে পাক সেনারা আসলেই আমি বাসা থেকে বের হয়ে তাদের সাথে আধা উর্দু আধা বাংলা মিশিয়ে কথা বলা শুরু করতাম৷ আমারও যে সর্বনাশ হতে পারে সেই কথা আমার একটুও মাথায় আসতো না৷ সেসময় আমার লক্ষ্য ছিল শুধু ঐ বাড়ির পরিবারটিকে বাঁচানো৷ তাই আমি পাক সেনাদের আমার বাসায় বসতে দিতাম, চা খাওয়াতাম৷ তারা যখন আমাকে জিজ্ঞেস করতো ঐ পরিবার সম্পর্কে তখন বলতাম যে, ঐ বাড়িতে শুধু এক বুড়ি মা ছাড়া আর কেউ নেই৷ প্রায় তিন চার দিন আমি পাক সেনাদের সাথে এভাবে ভাব জমিয়ে ঐ পরিবারটিকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলাম৷''
মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও দেশ ও জাতির কাজে নিবেদিত রয়েছেন রাজিয়া সরকার৷ মহিলা পরিষদ এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাথে কাজ করছেন তিনি৷ সমাজের নির্যাতিত নারী-শিশুর অধিকার রক্ষায় সোচ্চার সাহসী নারী রাজিয়া সরকার৷
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক