যে আইনে মামলা করলেন কিশোর
১৪ মার্চ ২০২১কিশোরের মামলায় মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েশ রবিবার আদেশ দেন৷ গত বছরের ৫ মে বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়৷ মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, তার তিনদিন আগে ২ মে বিকাল ৫টা ৪৫ মিনিটে বাসা থেকে সাদা পোশাকধারী ১৬/১৭ জন লোক তাকে মুখোশ পরিয়ে, হাতকড়া লাগিয়ে, নির্জন অচেনা জায়গায় নিয়ে যায়৷ এরপর ২-৩ মে পর্যন্ত তাকে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করা হয়৷ বিচারক পিবিআইকে দেয়া তদন্তের আদেশে লিখেছেন:
১. তদন্ত কর্মকর্তা হতে হবে পুলিশ সুপার (এসপি) পদমর্যাদার নিচে নয় এমন কোনো কর্মকর্তা৷
২. তিন সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করে কিশোরের নাক, কান, গলা কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং অন্যান্য জখমের বিষয়ে যথাযথ অনুসন্ধান করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিবেদন দিতে হবে৷
৩. আগামী ১৫ এপ্রিলের মধ্যে পিবিআইকে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে হবে৷
এই মামলায় কিশোরের আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়াকে ফোনে পাওয়া না গেলেও তিনি তার ফেসবুক পোস্টে এই আদেশের বিষয়ে জানান৷ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর তাপস কুমার পালও আদেশের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘এই আইনটি একটি আন্তর্জাতিক আইন৷ ফলে এর কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে৷ কিশোরের মামলায় কাউকে নাম উল্লেখ করে আসামি করা না হলেও এখন তদন্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব হচ্ছে অভিযুক্তদের চিহ্নিত করা৷ আর তিনি যে নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন তা নিশ্চিত হতেও মেডিক্যাল বোর্ড গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷ কারা তদন্ত করতে পারবে তাদের পদমর্যাদাও উল্লেখ করা হয়েছে৷’’
কী আছে আইনে
আইনটির শুরুতেই বলা হয়েছে, নিউ ইয়র্কে ১৯৮৪ সালের ১০ ডিসেম্বর নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহার অথবা দণ্ডবিরোধী একটি সনদ স্বাক্ষর হয়েছে৷ বাংলাদেশও ওই সনদের অংশীদার৷ তাই আইনটি করা হয়েছে৷
আরো বলা হয়েছে, ‘‘যেহেতু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদ নির্যাতন এবং নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহার ও দণ্ড মৌলিকভাবে নিষিদ্ধ করেছে এবং যেহেতু জাতিসংঘ সনদের ২(১) ও ৪ অনুচ্ছেদ নির্যাতন, নিষ্ঠুর, অমানবিক ও লাঞ্ছনাকর ব্যবহার ও দণ্ড অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করে নিজ নিজ দেশে আইন প্রণয়নের দাবি করে৷’’
বাংলাদেশে এই আইনে এখন পর্যন্ত মাত্র একটি মামলার বিচারের উদাহরণ আছে৷ মামলাও হয়েছে অনেক কম৷ ২০১৩ সালে আইনটি পাশ হওয়ার পর ২০১৪ সালে মিরপুরের পল্লবী এলাকায় জনি নামে এক ব্যক্তি পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনে মারা যান৷ তার পরিবার এই আইনে মামলা দায়ের করেন৷ ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর আদালত পল্লবী থানার তখনকার এসআই জাহিদুর রহমান জাহিদ, এসআই রশিদুল ইসলাম এবং এএসআই কামরুজ্জামান মিন্টুসহ এই তিন জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন৷ তাদের দুইজন সোর্সকে দেয়া হয় সাত বছরের কারাদণ্ড৷
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বলেন, ‘‘এই আইনটির অনন্য বৈশিষ্ট্য হলে যিনি ভুক্তভোগী বা অভিযোগকারী তাকে মামলা প্রমাণ করতে হবে না৷ তিনি অভিযোগ করার পর অভিযুক্তদেরই প্রমাণ করতে হবে তারা অপরাধী নন৷ প্রমাণে ব্যর্থ হলে তারা দোষী সাব্যস্ত হবেন৷’’
তার মতে, হেফাজতে নির্যাতন বা মৃত্যুর ঘটনা যেহেতু বাইরে ঘটে না তাই অভিযোগকারীর কাছে প্রমাণ সাধারণভাবে থাকে না৷ ফলে এই আইনের সুবিধা হলো অভিযোগকারীকে প্রমাণ সংগ্রহের চেষ্টা করতে হয় না৷ অন্যদিকে ডাক্তারি পরীক্ষাতেই নির্যাতন প্রমাণ হয়৷
এই আইনে সাধারণভাবে আদালতেই মামলা করতে হয়৷ আর পুলিশের কাছে করতে হলে সর্বনিম্ন এসপি পদমর্যাদার কর্মকর্তার কাছে করতে হবে৷ যদি এসপির বিরুদ্ধেই অভিযোগ হয় তাহলে তার উপরের কর্মকর্তার কাছে করা যাবে৷
শুধু পুলিশ নয়, হেফাজতে নেয়ার ক্ষমতাবান সরকারের যেকোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধেই মামলা করা যাবে, এমনকি সিভিল প্রশাসনের হলেও৷
তবে পুলিশ শুরু থেকেই এই আইনটির বিরোধিতা করে আসছে৷ আইন পাশের সময় তো করেছেই এমনকি প্রতিবছর পুলিশ দিবসে তারা এই আইনটি বাতিল বা সংশোধনের দাবি জানিয়ে আসছে৷ তাপস কুমার পাল বলেন, ‘‘হেফাজতে নির্যাতন এখানে একটা স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে৷ কাউকে আটকের সময় এবং আটকের পরে নির্যাতনের অনেক অভিযোগ পাওয়া যায়৷ সে কারণেই পুলিশ এই আইনটি চায় না৷’’
মামলা কেন কম?
প্রচারের অভাব এবং ভয়ের কারণে এই আইনে মামলার সংখ্যা খুবই কম৷ আবার অনেকেই এই আইনটির বিষয়ে জানেন না৷ তাই যারা মামলা করেন তারা দণ্ডবিধির অন্য ধারায় মামলা করেন, যাতে বিচার পাওয়া খুবই জটিল৷
মিরপুরের পল্লবীর ঘটনায় তিন পুলিশ কর্মকর্তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হওয়ার পর আইনটি কিছুটা আলোচনায় আসে বলে জানান অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর৷
অ্যাডভোকেট তুহিন হাওলাদার বলেন, ‘‘হেফাজতে মুত্যু বা নির্যাতনের যাতে ন্যায় বিচার মানুষ পায় সেই জন্যই এই আইনটি করা হয়েছে৷ কিন্তু সাধারণ মানুষ আইনটি সম্পর্কে জানেন না৷ এটা নিয়ে কোনো প্রচারের ব্যবস্থা নাই৷ এই ধরনের যে একটা আইন আছে সেটা অনেকে জানেনই না৷ আর পুলিশও শুরু থেকেই এই আইনটির বিরুদ্ধে থাকায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে৷’’
মামলা করার পর পরই আদালত নির্যাতনের শিকার ব্যক্তির স্বাস্থ্যপরীক্ষা ও তাকে সুরক্ষার আদেশ দেবেন আইনে এমনটা বলা হয়েছে৷ আর এই আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পাশাপাশি ক্ষতিপূরণেরও বিধান আছে৷ বিচার কাজ শেষ করতে হবে ১৮০ দিনের মধ্যে৷ বিচার হবে দায়রা জজ আদালতে৷
গত ১০ মার্চ ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক কে এম ইমরুল কায়েশের আদালতে মামলার আবেদন করেন কার্টুনিস্ট কিশোর৷ আদালত তার জবানবন্দি গ্রহণ করে নথি পর্যালোচনা শেষে রবিবার আদেশের জন্য রেখেছিলেন৷
কিশোর গত ৪ মার্চ জামিনে মুক্তি পান৷ এখন তিনি চিকিৎসাধীন আছেন৷ একই সময়ে আটক লেখক মুশতাক আহমেদ কারা হেফাজতে মারা যান ২৫ ফেব্রুয়ারি৷