প্রাইভেট এয়ারলাইন্স টেকে না?
১৪ মার্চ ২০১৮নেপালে বাংলাদেশের ইউএস-বাংলা এয়ার লাইন্সের উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার পর বাংলাদেশের প্রাইভেট এয়ার লাইন্সের সক্ষমতা এবং যাত্রীসেবা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে৷ প্রশ্ন উঠছে, বাংলাদেশের প্রাইভেট এয়ার লাইন্সগুলো কেন একের পর এক ঝরে পড়ছে?
বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে বড় প্রাইভেট এয়ার লাইন ইউএস-বাংলা এয়ার লাইন্স৷ আর বাকি দু'টি হলো নভোএয়ার ও রিজেন্ট এয়ার৷ ইউএস-বাংলা'র এখন আটটি অভ্যন্তরীণ এবং পাঁচটি আন্তর্জাতিক রুটে বিমান রয়েছে৷ নভোএয়ারের বিমান চলে সাতটি অভ্যন্তরীণ রুট এবং একটি আন্তর্জাতিক রুটে৷ রিজেন্ট এয়ার পাঁচটি অভ্যন্তরীণ এবং পাঁচটি আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে৷ নিয়ম অনুযায়ী, এক বছর অভ্যন্তরীণ রুটে উড়োজাহাজ চালানোর পর আন্তর্জাকি রুটে ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি দেয়া হয়৷
১৯৯৫ সালে বেসরকারি এয়ারলাইন্স অ্যারো বেঙ্গলকে ফ্লাইট অপারেশনের অনুমতি দেয়া হয়৷ তবে তারা যাত্রী পরিবহন শুরু করে ১৯৯৭ সালে৷ আর পরের বছরই এই এয়ারলাইন্সটি কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়৷ এরপর বাংলাদেশে একে একে কাজ শুরু করে এয়ার বাংলাদেশ, জিএমজি এয়ারলাইন্স, রয়েল বেঙ্গল ও বেস্ট এয়ার৷ এর কোনোটি এখন আর অপারেশনে নেই৷ আর্থিক সংকটের কারণ দেখিয়ে তারা বন্ধ করে দেয়৷ অ্যারো বেঙ্গলসহ ছয়টি প্রাইভেট এয়ার লাইন্সই তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নেয় আর্থিক কারণ দেখিয়ে৷ ওই এয়ারলাইন্সগুলোর মধ্যে শুধু জিএমজি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করতো৷
বাংলাদেশে মোট ১২টি প্রাইভেট এয়ারলাইন্স বিভিন্ন সময় অনুমোদন পেলেও দুইটি এয়ার লাইন্স কখনো অপারেশনেই আসেনি৷
এরপর ২০০৭ সালে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ যাত্রা শুরু করে ১১টি উড়োজাহাজ নিয়ে৷ পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করেও শেষ পর্যন্ত তারা টিকে থাকতে পারেনি৷ ১১টি প্লেনের নয়টি পর্যায়ক্রমে অকার্যকর হয়ে যায়৷ দু’টি প্লেন দিয়ে আরো কিছুদিন সচল থাকার পর ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ বন্ধ হয়ে যায়৷
২০১০ সাল থেকে রিজেন্ট এয়ার এবং ২০১৫ সাল থেকে নভো এয়ার ও ইউএস বাংলা ফ্লাইট অপারেশন শুরু করে৷ এই তিনটি এখনো টিকে আছে৷ রিজেন্ট এয়ারওয়েজও দেনায় পড়েছে৷ বেসামরিক বিমান চলাচলকর্তৃপক্ষ (বেবিচক)-এর কাছে তাদের ২৪ কোটি টাকা দেনা রয়েছে বলে জানা গেছে৷ তাদের বিমানবহরে রয়েছে ড্যাশ-৮ এবং বোয়িং৷ নভোএয়ার এটিআর-৭২-৫০০ এয়াক্রাফট দিয়ে যাত্রী পরিবহণ করে৷ ইউএস-বাংলা ড্যাশ এবং বোয়িং উড়োজাহাজ ব্যবহার করে৷
আগের এয়ারলাইন্সগুলো বন্ধ হয়েছে প্রধানত দু'টি কারণে৷ অব্যাহত লোকসান এবং ব্যবস্থাপনার ত্রুটি৷ ইউনাইটেড এয়ারকে তাদের ৮৪ কোটি টাকা দেনা তিন বছরে তিন কিস্তিতে শোধ করতে সুযোগ দেয়ার পরও টিকে থাকতে পারেনি৷
আবার নির্দিষ্ট সময় পরপর একটি উড়োজাহাজের ইঞ্জিন ও ল্যান্ডিং গিয়ারসহ গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে রক্ষনাবেক্ষণ প্রয়োজন৷ এ রক্ষণাবেক্ষণের একটি পর্যায় হলো সি-চেক৷ এই সি চেকে গিয়ে আটকে যায় কোনো কোনো এয়ার লাইন্সের উড়োজাহাজ৷একটি এয়ারলাইন্সের ১১টির মধ্যে ছয়টি উড়োজাহাজ সি-চেক-এর কারণে বসে থাকতে হয়েছে দীর্ঘদিন৷
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ এবং বিমান বোর্ডের সাবেক পরিচালক ওয়াহিদুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘একটি প্রাইভেট এয়া্রলাইন্স চালানোর জন্য যে ধরনের উদ্যোক্তা দরকার, যেমন দক্ষতা দরকার, ব্যবস্থাপনা দরকার সেগুলো আমাদের এখানে এখনো হয়নি৷ ফলে এখানে অনেকেই টিকে থাকতে পারছে না৷ এয়ারলাইন্স ব্যবসা অনেক জটিল ব্যবসা৷ এটা অন্য পরিবহণ ব্যবসার মতো নয়৷ অনেকে মনে করে এটা লাভজনক ব্যবসা, তাই আসে৷ মনে করে এই ব্যবসা করলে একটা পজিশন হবে৷ একটা এয়ারক্রাফট দিয়ে ব্যবসা শুরু করে৷ কিন্তু সেই এয়ারক্রাফট যখন মেজর চেকের জন্য যায়, তখন বড় ধরনের ইনভেস্টমেন্টের প্রয়োজন হয়৷ এছাড়া সিলেকশন অব এয়ারক্রাফট, রুট প্ল্যানিং এসবেও সমস্যা আছে৷ আর আগে লোড হিসাব করে ব্যবসা হিসাব করা হতো৷ এখন আয় এবং ম্যানেজমেন্টের ব্যালেন্স করতে হয়৷ কেউ যতি টিকেটের দাম কমিয়ে যাত্রী লোড বাড়িয়ে ফেলে৷ তাতে ব্যবসা না-ও হতে পারে৷''
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘বাংলাদেশে ড্যাশ-৮ এয়ারক্রাফট বেশি ব্যবহার হয়৷ গত ১৫ বছর ধরে ব্যবহার করা হচ্ছে৷ ফলে এই এয়ারক্রাফট চালানো ও পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় জনবল এখানে আছে৷ আর থাকার কারণেই এই এয়ারক্রাফট ব্যবহারের প্রবণতা বেশি৷ অন্য ধরনের এয়ারক্রাফট আনলে নতুন করে জনবল তৈরির প্রয়োজন হবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘প্রাইভেট এয়ারলাইন্সগুলোর যাত্রীসেবার মান ভালো হচ্ছে, কারণ, তাদের এখন আন্তর্জাতিকভাবে অনেক ভালো এয়ারলাইন্সের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘ইউএস-বাংলার বিমান দুর্ঘটনার কারণে সাময়িকভাবে বাংলাদেশের প্রাইভেট এয়ার লাইন্সের ব্যবসায় নেতবিাচক প্রভাব পড়তে পারে৷ কিন্তু এটা স্থায়ী হবে বলে আমার মনে হয় না৷''
ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলার সময় রিজেন্ট এয়ার-এর চিফ কমার্শিয়াল অফিসার আখতার ইউ আহমেদ দাবি করেন, ‘‘বাংলাদেশের প্রাইভেট এয়ারলাইন্সগুলোর যাত্রীসেবা অনেক ভালো, কারণ, আমাদের আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্সগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে যাত্রী পেতে হয়৷ যাত্রী সেবার প্রথম শর্ত হলো শিডিউল মতো ফ্লাইট অপরেশন৷ আমরা সেটা চেষ্টা করি৷ আর অনবোর্ড সার্ভিসও মান সম্পন্ন৷''
তাহলে বাংলাদেশে প্রাইভেট এয়ারলাইন্স কেন বন্ধ হয়ে যায়? কেন ব্যবসা করতে পারে না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,‘‘লাভ-লোকসানের এই হিসাব তো আমি দিতে পারবো না৷ আর কেন টিকতে পারছে না এর কোনো সিম্পল আনসার নাই৷''
অন্যদিকে এভিয়েশন বিষয়ক সিনিয়র সাংবাদিক আবুল আজাদ সুলায়মান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রাইভেট এয়ারলাইন্সের যাত্রীসেবা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের চেয়ে ভালো৷ তারা এটাকে গুরুত্ব দেয়৷ কিন্তু এরা ড্যাশ-৮ এর ওপর বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল৷ ইউএস-বাংলার ড্যাশ-৮ বিমান দুর্ঘটনার পর এটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে৷ এটা কিছু দেশ ব্যবহার করলেও ইউরোপ এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অনেক দেশ এই উড়োজাহাজ ব্যবহার করছে না৷ কারণ, এর ল্যান্ডিং গিয়ার ত্রুটিপূর্ন৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘আমাদের দেশে যারা প্রাইভেট এয়ালাইন্সের ব্যবসা করেন, তারা এটাকে আলু-পটলের ব্যবসার মতো মনে করেন৷ তাদের এটা করার দক্ষতা এবং যোগ্যতা নাই৷ তারা মনে করে, এ ব্যবসা করলে তাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে৷ আর অনেক ব্যবসা হবে৷ কিন্তু ব্যবসায় নেমে যখন আর পারে না, তখন কোম্পানি বন্ধ করে দেয়৷ কারণ, এয়ারক্রাফট ওভারহলিং সম্পর্কে তাদের আগে ধারণা থাকে না৷ এটা ব্যয়বহুল৷ যখন করতে হয়, তখন ব্যবসার পুঁজিই শেষ হয়ে যায়৷''
প্রতিবেদনটি সম্পর্কে আপনার মন্তব্য লিখুন নীচের ঘরে৷