রাঙামাটি, খাগড়াছড়িতে আতঙ্ক কাটেনি
২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪রাঙামাটি ও খাড়াছড়ির কয়েকজন বাসিন্দার সাথে কথা বলে জানা গেছে, রোববার কোনো সংঘর্ষের ঘটনা না ঘটলেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি৷ ইউপিডিএফের অবরোধ কর্মসূচি ও পরিবহণ ধর্মঘটের কারণে জনজীবন বলতে গেলে অচলই আছে৷ জেলা শহরের লোকজন প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন না৷ সবার মধ্যে আতঙ্ক রয়েছে৷ জেলা প্রশাসন সম্প্রীতি বৈঠক ডেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে৷ রাঙামাটির এজজন বাসিন্দা ইলিয়াস আহমেদ জানান, ‘‘হামলা, সংঘর্ষ ,ধ্বংসযজ্ঞে স্থানীয় মানুষ স্তম্ভিত হয়েছেন৷'' একই ধরনের কথা বলেন খাগড়াছড়ির বাসিন্দা চিংমে মারমা৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘রোববার নতুন কেনো সংঘাত-সংঘর্ষ না হলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক কাটেনি৷ অবরোধ ও পরিবহণ ধর্মঘটের কারণে জনজীবন এখনো বলতে গেলে অচল৷''
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে শহরের বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি পুলিশ ও বিজিবি মোতায়েন রয়েছে৷ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের কাজ চলছে৷
‘পাহাড়িদের ওপর হামলা, খুন, বৌদ্ধ বিহার ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনার প্রতিবাদে’ ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) ৭২ ঘণ্টার সড়ক ও নৌপথ অবরোধ চলছে৷ শনিবার থেকে এই অবরোধ শুরু হয়৷ দ্বিতীয় দিনে রাঙামাটি-নানিয়ারচ-মহালছড়ি-খাগড়াছড়ি সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে৷ সাজেকে আটকা পড়েছেন প্রায় দেড় হাজার পর্যটক৷
মামুন হত্যা মামলায় আসামি আওয়ামী লীগের তিন নেতা
গত বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) খাগড়াছড়ি সদরে মোটরসাইকেল চুরিকে কেন্দ্র করে গণপিটুনিতে মো. মামুন (৩০) নামের এক বাঙালি যুবকের মৃত্যু হয়৷ এই ঘটনা থেকেই পাহাড়ে বাঙালি ও আদিবাসীদের মধ্যে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে৷ দুই জেলায় নিহত হন মোট চারজন৷ গণপিটুনিতে মোহাম্মদ মামুন নিহত হওয়ার ঘটনায় বৃহস্পতিবার তার স্ত্রী মুক্তা আক্তার বাদী হয়ে তিন জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেছেন৷ তারা হলেন মো. শাকিল, রফিকুল আলম ও দিদারুণ আলম৷ তাদের মধ্যে রফিকুল আলম আওয়ামী লীগের নেতা ও খাগড়াছড়ি পৌরসভার সাবেক মেয়র৷ আরেক আসামি দিদারুল তার ভাই ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং মো. শাকিলও আওয়ামী লীগের নেতা৷ এই তিনজনসহ ১০ থেকে ১২ জন অজ্ঞাতনামা ‘উপজাতি ও বাঙালি'র কথাও আসামি হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি৷ তিন আসামিই গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে পলাতক বলে স্থানীয় পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে৷
আদিবাসী নেতা ও মানবাধিকারকর্মী ইলিরা দেওয়ান ডয়চে ভেলেক বলেন, ‘‘যে হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে দুই জেলায় আদিবাসীদের ওপর হামলা চালানো হলো, ঘরবাড়িতে আগুন দেয়া হলো৷ চারজন নিহত হলো৷ সেই মামলার এজাহারে যাদের নাম আছে তারা কেউই আদিবাসী নন৷ তাহলে আমার প্রশ্ন আদিবাসীদের ওপর হামলা কেন করা হলো?’’
‘দুই পক্ষকে নিয়েই আস্থার পরিবেশ তৈরি করতে হবে’
শনিবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিষয়ক উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি সফর করেছেন ৷ ওই দুই জেলায় সংঘর্ষে চারজন নিহত হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে স্থানীয় জনগণ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন তারা৷
উপদেষ্টারা রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলা সদরে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, ব্যবসায়ী ও বাণিজ্য সংস্থার প্রতিনিধি, গণমাধ্যম প্রতিনিধি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং জেলা পরিষদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ৷
তাদের সফরের পর আস্থার পরিবেশ তৈরি হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে ইলিরা দেওয়ান বলেন, ‘‘পত্রিকায় পড়েছি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন সন্ত্রাসী৷ বলেছেন বেশি বাড়াবাড়ি করলে হাত গুঁড়িয়ে দেয়া হবে৷ তবে তিনি কাদের সন্ত্রাসী বললেন , কাদের হাত গুঁড়িয়ে দেবেন তা পরিস্কার করেননি৷ এটা পরিষ্কার হওয়া দরকার৷''
তিনি মনে করেন পরিস্থিতির উন্নয়নে পাহাড়ি-বাঙালি দুই পক্ষকে নিয়েই আস্থার পরিবেশ তৈরি করতে হবে৷ এমন কিছু দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে এই পরিবেশ তৈরি হয়৷ ইলিরা দেওয়ান বলেন, ‘‘সেটা এখনও দৃশ্যমান নয়৷ যারা প্রকৃতই এই ঘটনার জন্য দায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে৷ যারা প্রোপগান্ডা ছাড়ালো তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে৷ নিরাপত্তা দিতে হবে৷’’
শনিবার তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম খাগড়াছড়ি দীঘিনালা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় স্থানীয় এলাকাবাসীর সাথে মতবিনিময় করেন৷ এসময় তিনি হত্যাকাণ্ডের বিচার ও সহায়তার আশ্বাস দেন বলে জানিয়েছে বাংলাদেশের সংবাদ সংস্থা বাসস৷ নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘‘পাহাড়ে নানা ধরনের বৈষম্য রয়েছে৷ এখানে বসবাস করা জনগোষ্ঠীর নানা রকমের বঞ্চনা রয়েছে৷ আমরা লড়াই সংগ্রাম করে যে নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছি সেখানে কোন বৈষম্য থাকবে না৷
সবার সহযোগিতায়ে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যাশার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘পাহাড়ে যারা ভেদাভেদ, দূরত্ব তৈরি করে সুযোগ নিতে চায় তাদের কোনভাবে সুযোগ দেয়া যাবে না৷ পাহাড়-সমতল মিলে বাংলাদেশ৷’’
অনিক চাকমা হত্যা: অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা
শুক্রবার রাঙামাটিতে অনিক চাকমাকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায়ও মামলা হয়েছে৷ নিহত অনিকের বাবা আদর সেন চাকমা বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন৷ তবে আরো যারা নিহত হয়েছেন তাদের ব্যাপারে এখনো মামলা হয়নি৷
এদিকে খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে ‘পাহাড়িদের উপর গুলিবর্ষণ, হত্যা, ঘরবাড়ি, দোকানপাট, ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগের' প্রতিবাদে ঢাকার শাহবাগে রোববার প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে৷ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের আয়োজনে এই প্রতিবাদ সমাবেশ হয়৷
পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আহসান হাবিব জানান,‘‘দুই পার্বত্য জেলার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে তা বলবো না৷ তবে আমরা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছি৷ স্বাভাবিক জনজীবন যাতে শুরু হয় আমরা সেই চেষ্টা করছি৷ তবে আজকে (রোববার) কোনো সংঘাত, সহিংসতা বা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি৷''
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘কী পরিমাণ ক্ষয়কতি হয়েছে তা জানতে একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি গঠন করা হবে৷ তিন জন উপদেষ্টা ওই দুই জেলা পরিদর্শন করেছেন৷ তারাই এ নিয়ে কথা বলেছেন৷''
রোববার সকালে রাঙামাটির বনরুপা এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন ‘রাঙামাটি রিজিয়ন কমান্ডার' ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শওকত ওসমান, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন খান, জেলা পুলিশ সুপার এসএম ফরহাদ হোসেনসহ প্রশাসনের ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তরা৷ এ সময় তারা ক্ষতিগ্রস্ত ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেন৷