1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে অর্থনীতি

জাকির হোসেন
১ ডিসেম্বর ২০২৩

বাংলাদেশে আগামী ৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে৷ টানা তিন মেয়াদে সরকারে থাকা রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনের মাঠে নেমে পড়েছে৷

https://p.dw.com/p/4ZeXv
কারওয়ানবাজারের একটি দোকান৷
বাজারে জিনিসপত্রের দামের ঊর্ধ্বগতির হার এখন গত এক যুগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি৷ছবি: Samir Kumar Dey/DW

প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচনে আসতে চাইছে না৷ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর তারা অবরোধ ও হরতালের ডাক দিয়ে যাচ্ছে৷ এরই মধ্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী গ্রেফতার হয়েছেন৷ ফলে রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে৷ 

নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক সংকট নতুন কিছু নয়৷ কিন্তু এবার এমন এক সময়ে নির্বাচন ঘনিয়ে এসেছে, যখন দেশের অর্থনীতি বেশ সংকটাপন্ন৷ বাজারে জিনিসপত্রের দামের ঊর্ধ্বগতির হার এখন গত এক যুগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি৷ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উদ্বেগজনকভাবে কমেছে৷ টাকা অনবরত দর হারাচ্ছে৷ বিদেশের সঙ্গে লেনদেনে ঘাটতি বেড়েছে৷ বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপও বেড়েছে৷ সরকারকে এর পরিণতিতে ব্যয় সংকোচন করতে হচ্ছে৷ সরকারের নীতির প্রভাবে বেসরকারি খাতও ম্রিয়মান হয়ে পড়েছে৷ সব মিলিয়ে অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে৷ এ পরিস্থিতিতে রাজনীতি ও নির্বাচনের সাথে অর্থনীতির আলোচনা বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে৷

সাধারণ মানুষের আলোচনায় আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অর্থনীতির প্রসঙ্গ এখন বেশি বেশি উঠে আসছে৷ শুধু জিনিসপত্রের দাম নিয়ে নয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কিংবা বৈদেশিক ঋণের পরিমাণের হালনাগাদ পরিসংখ্যান নিয়েও মানুষ কথা বলছে৷ অনেকে জানতে চাইছেন, দেশের অর্থনীতির অবস্থা আসলে কেমন৷ বাজারে জিনিসপত্রের দাম আরও বাড়বে কি–না৷ ডলারের দাম আর কত বাড়বে৷  কেউ কেউ এমনও জিজ্ঞেস করছেন, শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থতি হবে কি–না৷

কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও কিছু সংকট দেখা যাচ্ছে যার সঙ্গে গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকার, শ্রম অধিকার ইত্যাদি বিষয় যুক্ত৷ ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর ভিসা নীতির প্রয়োগ শুরু করেছে৷ গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যারা বাধার সৃষ্টি করবে, তারা সেদেশের ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বেন৷ সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বে শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠায় একটি স্মারক অনুমোদন করেছে৷ কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্র শ্রম অধিকার ক্ষুন্ন করেছে মনে করলে যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞাসহ অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবে৷ বাংলাদেশ এ ধরনের নিষেধাজ্ঞায় পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে৷ আর যদি তা ঘটে তাহলে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য নিশ্চিতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ কেননা বাংলাদেশ থেকে একক দেশ হিসেবে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে৷ অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নও শ্রম অধিকার ও মানবাধিকার ইস্যুতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে, যা তারা আমদানির উৎস দেশগুলোতে বাস্তবায়ন করতে চায়৷ ইইউ এবং যুক্তরাষ্ট্র  বাংলাদেশের মূল বাজার৷ ফলে রপ্তানিকারকদের মধ্যে এসব বিষয়ে যথেষ্ট উদ্বেগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে সরকারকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতির অন্যতম টার্গেট হতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক কারণে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলেও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে৷

সরকারও মনে করছে, নির্বাচন ঘিরে বিভিন্ন তৎপরতার কারণে অর্থনৈতিক চাপ আসতে পারে ৷ সরকারের নীতি-নির্ধারকদের বক্তব্যে এমন কথা-বার্তা আসছে৷ প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল সম্প্রতি বলেছেন, দেশের অর্থনীতি ও ভবিষ্যৎ রক্ষায় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে হবে৷ অথনীতিবিদেরা বলছেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে অর্থনৈতিক সংকট গভীর হবে৷ সার্বিকভাবে অর্থনীতির স্বার্থেই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন বলে তারা মনে করছেন৷

এদিকে রাজনৈতিক সংকট বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের মধ্যে অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে দিচ্ছে৷ উদ্যোক্তা এবং বিনিয়োগকারীরা এ ধরণের অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন৷ বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা চুপচাপ বসে আছেন৷ কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভনর্রই বলেছেন, বর্তমানে নতুন পুঁজি বা ইক্যুয়িটি আকারে বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) আসছে না৷ বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এখন যা বিনিয়োগ করছেন, তা মূলত এখানকার আয় থেকে পুনর্বিনিয়োগ৷ উল্লেখ করা যেতে পারে, কয়েক বছর আগে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেশ স্বস্তিদায়ক অবস্থায় ছিল৷ তখন বেসরকারি খাতকে কম সুদে বড় অংকের বিদেশি ঋণ নেওয়ার সুযোগ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক৷ তবে এখন সেই ঋণ পরিশোধের চাপে পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ৷ সব মিলিয়ে একদিকে বৈদেশিক মুদ্রা আসার প্রবাহে গতি কম, অন্যদিকে দায়দেনা পরিশোধের চাপ অর্থনীতিতে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে৷

দায়দেনা পরিস্থিতি কেমন

বছর দুয়েক ধরে সরকারের দায়দেনা পরিস্থিতি নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে৷ কারণ সরকারের দেনা বেড়ে গেলে অর্থনীতিকে বড় সংকটে ফেলতে পারে৷ সরকার ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে মূল্যস্ফীতি দ্রুতগতিতে বেড়ে বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌছে যেতে পারে৷ এর পরিণামে দেশে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে৷ শ্রীলঙ্কা যার বড় উদহারণ৷ অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত হয়ে গণবিক্ষোভের ফলে গত বছর শ্রীলঙ্কায় রাজাপাক্সে সরকারের পতন হয়েছে৷ দেশটির সঙ্কটের মূল কারণ ছিল অপরিকল্পিত বিদেশি ঋণ নিয়ে তা ফেরত দিতে না পারা এবং ব্যাপকভাবে কর কমানোর কারণে  রাজস্ব আয়ে মারাত্বক পতন৷ রাজাপাকশে সরকারের ভূল অর্থনৈতিক নীতি শেষ পর্যন্ত দেশটিকে খাদ্য ও জ্বালানি ঘাটতির মুখে ফেলে৷ মূল্যস্ফীতি ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়৷ মানুষ খাদ্য সংকেট পেড়ে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ শুরু করে৷

জাকির হোসেন, সাংবাদিক
জাকির হোসেন, সাংবাদিকছবি: privat

গত সেপ্টেম্বর শেষে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের স্থিতি ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে – যার মধ্যে সরকারি খাতে ৭৯ বিলিয়ন ডলার এবং বেসরকারি খাতে ২১ বিলিয়ন ডলার৷ আইএমএফের ডেট সাসটেইনিবিলিটি অ্যানালাইসিস' অনুসারে বাংলাদেশের সরকারের মোট দায়দেনা (অভ্যন্তরীণ ঋণসহ) দেশের জিডিপির ৩৪ শতাংশের মতো, যা গ্রহণযোগ্য মাত্রার৷ কিন্তু অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ জিডিপির অনুপাতে দায়দেনার ব্যাখ্যাকে পরিস্থিতি অনুধাবনের জন্য যথার্থ মনে করেন না৷ আইএমএফের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং বর্তমানে গবেষণা সংস্থা পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক ড.আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, বাংলাদশের কর-জিডিপি অনুপাত মাত্র ৮ শতাংশ৷ এর অর্থ নিজস্ব আয় দিয়ে বাংলাদেশ ঋণ পরিশোধে সক্ষম নয়৷ এ কারণে জিডিপির সঙ্গে ঋণের অনুপাত হিসাব করে লাভ নেই৷ তুলনা করতে হবে রাজস্বের সঙ্গে৷ বাংলাদেশে ঋণ-রাজস্ব অনুপাত ৪০০ শতাংশের বেশি৷  তার মতে, ২০০ থেকে ২৫০ শতাংশের মধ্যে থাকলেও চলে, কিন্তু ৪০০ শতাংশ বিপজ্জনক মাত্রার৷ (বণিক বার্তা,২২ নভেম্বর, ২০২৩)৷ জিডিপির অনুপাত বা রাজস্ব অনুপাতের বিবেচনার আলোচনার বাইরে এটা বলা যায়, বিদেশি ঋণ গ্রহণ গত কয়েকবছরে বেশ বেড়েছে এবং চীন, রাশিয়ার কাছ থেকে দ্বিপক্ষীয় বড় অংকের ঋণ নেওয়া হয়েছে৷ এর ফলে আগামীতে ঋণ পরিশোধ স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হারে বাড়বে এবং বৈদেশিক মুদ্রার আয় সেই হারে না বাড়লে পরিস্থিতি জটিল হতে পারে৷

রিজার্ভ: স্বস্তি থেকে উদ্বেগ

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অতীতে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার বিষয় হয়েছে৷ করোনার সংক্রমণের কারণে চাহিদা কমে যাওয়ায় রিজার্ভ বাড়তে থাকে এবং তা ২০২১ সালের আগষ্ট মাসে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে ওঠে৷ তখন রিজার্ভের পরিমাণ নিয়ে সরকারের বেশ স্বস্তি ছিল এবং রাজনৈতিক সাফল্য হিসেবে এ নিয়ে প্রচারও ছিল৷ করোনা পরবর্তী চাহিদা আমদানি ব্যয় বাড়িয়ে দিলে রিজার্ভ কমতে থাকে৷ কমতে কমতে সেই রিজার্ভ (গ্রস হিসাব) এখন ২৫ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে৷ আর স্থানীয় বিনিয়োগ বাদ দিয়ে আইএমএফের বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভের পরিমাণ এখন ২০ বিলিয়নের নিচে৷ রিজার্ভ ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে৷ আমদানি দমিয়ে রেখে রিজার্ভের পতন ঠেকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে৷ উদ্যোক্তারা প্রয়োজনীয় শিল্পপণ্য ও যন্ত্রপাতি অনেক সময় আমদানি করতে পারছে না৷ এতে করে অর্থনীতির সম্প্রসারণ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে৷ অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপে ব্যাংকগুলো টাকা-ডলারের একটা দর নির্ধারণে রাজি হলেও বাজার ওই দরে সাড়া দিচ্ছে না৷ ফলে নানা জটিলতা হচ্ছে, ডলার ধরে রাখার প্রবণতা বাড়ছে এবং রেমিট্যান্সের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে৷

নির্বাচনের পর অর্থনীতির গতি ফিরবে?

সরকারের নীতি নির্ধারকরা বলছেন, অর্থনীতিতে গতি আনতে যেসব সংস্কার দরকার, তার অনেক কিছুই নির্বাচনের আগে করা যাচ্ছে না৷ নির্বাচনের পর সংস্কারে মনোযোগী হবে সরকার৷ আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ার জন্য এমন বার্তা তাদেরকেও দেওয়া হয়েছে৷ এখন সংস্কার কীভাবে হবে, মানুষের ওপর তার প্রভাব কেমন হবে, তার ওপর নির্ভর করছে সংস্কারের সাফল্য৷ কর আদায় বাড়াতে যেয়ে যদি নিম্নআয়ের মানুষের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়, জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় দরে যদি মূল্যস্ফীতি আরও বাড়িয়ে দেয় – তাহলে সেই সংস্কার চলমান বৈষম্য আরও বাড়াবে৷ সবচেয়ে বড় কথা নির্বাচন শেষ পর্যন্ত দেশের রাজনীতিকে কোথায় নিয়ে যায়, তার ওপর নির্ভর করবে অর্থনীতির কী হবে৷