মার্কিন ভিসানীতি পাল্টে দিয়েছে অনেক কিছু
১৩ অক্টোবর ২০২৩২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ছিল হরতাল-অবরোধের মধ্যে গাড়িতে আগুন আর পেট্টোল বোমা হামলা। ফলে ঢাকা শহরের বাসিন্দাদের এক ধরনের আতঙ্ক নিয়েই ঘর থেকে বের হতে হতো। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড না থাকলেও রাজনীতির মাঠ বেশ গরম ছিল। নানা ধরনের মিটিং-সিটিংয়ের মধ্যে ব্যস্ততা ছিল রাজনীতিবিদদের। এবার, অর্থাৎ ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে যে নির্বাচনটি হতে যাচ্ছে, এটি নিয়ে নেই ‘সন্ত্রাসী' কর্মকাণ্ড। অন্যদিকে প্রধান দুই দল কিছু সমাবেশ করলেও মিটিং-সিটিংয়ের ব্যস্ততা খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। আগের দু'টি নির্বাচনে রাজনীতিবিদদের ব্যস্ততা দেখা গেলেও এবারের ভোট যেন উত্তাপ ছড়িয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যেও।
সাধারণ মানুষের মধ্যে কেন এই উত্তাপ? এবার আসি সেই প্রসঙ্গে। গত মে মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য ভিসানীতি ঘোষণা করে। মূলত এই ভিসানীতিই পাল্টে দিয়েছে অনেক কিছু। রাজনীতিবিদদের আচরণ যেমন বদলে গেছে, তেমনি আচরণ বদলে গেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বা প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের। এমনকি ঢাকার পত্রিকা অফিসের নিউজরুমের চিত্রও পাল্টে গেছে। আগে যেখানে মিডিয়াগুলোতে সরকারের নিউজ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হতো, এখন সেখানে গুরুত্ব পাচ্ছে বিরোধী দলের সংবাদও। কী জাদু আছে ওই ভিসানীতিতে? ঢাকায় আমি যে মিডিয়া হাউজে কাজ করি, তার নীচে ফুটপাতে চায়ের দোকানে প্রতিদিনই বিপুল সংখ্যক সাংবাদিকের আড্ডা হয়। সেই আড্ডার বিষয়বস্তুও এখন ভিসানীতি। এর মধ্যে আবার আগুনে ঘি ঢেলেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। তিনি বলেছেন, সংবাদমাধ্যমও ভিসানীতির আওতায় আসতে পারে। এতদিন সাংবাদিকরা মোটামুটি নিশ্চিত ছিলেন সুষ্ঠু নির্বাচন বিঘ্নকারী ব্যক্তিরা ভিসানীতির আওতায় পড়বেন। অর্থাৎ, সাংবাদিকরা এর মধ্যে পড়বেন না। কিন্তু পিটার হাসের নতুন এই বক্তব্য সাংবাদিক মহলে বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের পর সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। এমনকি তথাকথিত তালিকাও ছড়িয়ে পড়েছে। সেই তালিকায় আওয়ামী লীগপন্থি সিনিয়র সাংবাদিক, সাংবাদিক নেতা, পত্রিকার সম্পাদকসহ প্রায় একশ' সাংবাদিকের নাম এসেছে। এর মধ্যে আবার ৭ জন সাংবাদিক নেতা ফ্রান্সে একটি অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য ভিসার আবেদন করেছিলেন। কিন্তু তাদের ভিসা না হওয়ায় অলিতে গলিতে সাংবাদিকদের আড্ডায় ভিসানীতি বাস্তবায়ন হয়েছে বলে আলোচনা হচ্ছে। এখন সামাজিক মাধ্যমে লেখালেখির ব্যাপারেও সাংবাদিকরা বেশ সাবধান। পত্রিকাগুলোর রিপোর্টে যেমন ভারসাম্য এসেছে, সাংবাদিকদের কথাবার্তায়ও এক ধরনের পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। প্রশাসন বা পুলিশের কর্মকর্তারাও বেশ সতর্ক।
এর আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাবের উর্ধ্বতন ৭ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল তখন কিন্তু এত আলোচনা হয়নি। কারণ, তখন নির্দিষ্ট ছিল যে, এই ৭ জনের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। ফলে অন্যরা খুব একটা গা করেনি। কিন্তু এবারের ভিসানীতি সচেতন সবাইকেই নাড়া দিয়েছে। যিনি কোনোদিন অ্যামেরিকায় যাননি, তিনিও সতর্ক। আর যাদের যাওয়া-আসা আছে, তারা তো আরও বেশি আতঙ্কের মধ্যে আছেন। কী করলে আবার কী হয়, ফলে অনেকটা নিশ্চুপ তারা। বিরোধী পক্ষও এই ভিসানীতির এক ধরনের সুবিধা পেয়েছে।
এবার আসা যাক আর্থিক নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে। এখনও এই ধরনের কোনো নিষেধাজ্ঞা না এলেও ব্যাপকভাবে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। যদিও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম দুই দিন আগে বলেছেন, নির্বাচনের আগে আর কোনো নিষেধাজ্ঞা আসবে না। কিন্তু তার এই বক্তব্যে কেউ আস্বস্ত হতে পরছেন না। বিশেষ করে ব্যবসায়ি মহল আর্থিক নিষেধাজ্ঞা নিয়ে খুবই শঙ্কিত। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতিতে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে সম্প্রতি একটি প্রস্তাব কণ্ঠভোটে গৃহীত হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ‘এভরিথিং বাট আর্মসের' (ইবিএ) সুবিধা অব্যাহত রাখা উচিত কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা। এমনটি হলে পোশাক রপ্তানির উপর কেমন প্রভাব পড়তে পারে? বিষয়টি নিয়ে কথা হচ্ছিল পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ'র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ফজলুল আজিমের সঙ্গে। তার মতে, ইবিএ সুবিধা বাতিল হলে আমরা ভয়াবহ বিপদে পড়বো। কারণ, আমাদের পুরো রপ্তানির ৬০ ভাগই যায় ইউরোপে। এটা হলে আমাদের অর্থনীতি একটা মহাসংকটে পড়বে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বাংলাদেশের মিডিয়াও খুবই সতর্কভাবে রিপোর্ট করছে। খুব বেশি রিপোর্টও দেখা যাচ্ছে না। ব্যক্তির উপর নিষেধাজ্ঞা আর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তো এক জিনিস নয়।
সম্প্রতি বাংলাদেশের কয়েকটি পত্রিকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সম্পদ থাকা ব্যক্তিদের নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। আমলাদের মধ্যে কার কার ছেলে-মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করে, তাদের তালিকাও এসেছে। কারা অবৈধভাবে অর্থ পাঠিয়ে সেখানে বাড়ি কিনেছেন, এমন কিছু নামও এসেছে। রাজনীতিবিদদের বাইরেও প্রশাসনের অনেকের নাম আছে এই তালিকায়। তবে সবক্ষেত্রেই যে খুব বেশি যাচাই-বাছাই করে এগুলো ছাপা হচ্ছে, এমনটিও নয়। এই ধরনের খবরগুলো পাঠককে এই মুহুর্তে খুবই আকৃষ্ট করছে। ফলে নিয়মিতই কিছু না কিছু খবর ছাপা হচ্ছে। নিউজরুমগুলোতে নিউজ যা-ই হোক, প্রতিদিনই আলোচনার বিষয়স্তু এরপর কী হবে? কী পদক্ষেপ নেবে যুক্তরাষ্ট্রসহ তার মিত্র পশ্চিমারা। আর কারাই বা থাকবেন এই তালিকায়? নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে এই ধরনের আলোচনা ততই বাড়তে থাকবে এটা মোটামুটি নিশ্চিত করে বলা যায়।