রাজনীতিতে নতুন হিসাব, নতুন কৌশল
১২ ডিসেম্বর ২০২২বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’৷ এখন নির্ভার শাসক দল আওয়ামী লীগও রাজনীতিতে নতুন কৌশল খুঁজছে৷ তারা এখন নির্বাচনের আগের এক বছর কীভাবে বিরোধী রাজনীতিকে ‘ট্যাকল' করবে তা ভাবছে৷ তারা মনে করছে বিএনপির, ‘‘১০ ডিসেম্বরের ফ্লপ শো’ তাদের শক্তি বাড়িয়েছে, নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত করেছে৷ তাদের মাথায় এখন বিদেশি চাপ কীভাবে উপেক্ষা করা যায় সেই দিকে৷ আর বিএনপির তৃণমূলের ‘আশা ১০ তারিখে পুরণ না হলেও’ বিএনপি নেতারা মনে করছেন আন্দোলন আরো বেগবান হয়েছে৷ তাদের সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ করায় আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি আরো শক্ত হয়েছে৷
বিএনপির ফের জামায়াত নির্ভরতা
বিএনপির ২০ দলে জামায়াত থাকলেও তাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছিলো৷ গত আগস্টে এই বিচ্ছিন্নতা প্রকাশ পায় জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমানের বক্তব্যে৷ তিনি তখন জামায়াতের এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে বলেন, ‘‘আমরা এতোদিন একটা জোটের সঙ্গে ছিলাম৷ ছিলাম বলে আপনারা হয়তো ভাবছেন কিছু হয়ে গেছে নাকি? আমি বলি হয়ে গেছে৷ ২০০৬ সাল পর্যন্ত এটি একটি জোট ছিল৷ ২০০৬ সালের ২৮শে অক্টোবর জোট তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে৷ সেদিন বাংলাদেশ পথ হারিয়ে ছিল৷ সেটা আর ফিরে আসেনি৷ বছরের পর বছর পর এই ধরনের অকার্যকর জোট চলতে পারে না৷” এরপর বিএনপি নেতারাও জামায়াত নিয়ে ছিলেন চুপচাপ৷ কিন্তু ১০ ডিসেম্বর সমাবেশের আগেই জামায়াত নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হয় বিএনপির৷ জামায়াত এরইমধ্যে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে যোগ দিয়েছে৷ তারা বিএনপির ১০ দফায় সমর্থন দিয়েছে৷ তারা ১৩ ডিসেম্বর বিএনপির প্রতিবাদ মিছিল ও ২৪ ডিসেম্বর গণ মিছিলেও সমর্থন দিয়েছে৷ তারা এই কর্মসূচি তাদের ব্যানারে আলাদাভাবে পালন করবে৷ ১০ ডিসেম্বর জাময়াত আমীর ডা. শফিকুর রহমানও বিএনপির সঙ্গে মিলিয়ে ভার্চুয়াল মাধ্যমে ১০ দফা ঘোষণা করেন৷
জামায়াতের নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা বিএনপির সঙ্গে একই কর্মসূচি আলাদা ব্যানারে পালন করব, তবে একই মঞ্চে নয়৷ দুই দলের নেতারা পারষ্পরিক যোগাযোগের মাধ্যমে কর্মসূচি জানবেন৷ এখন পর্যন্ত কোনো লিয়াজোঁ কমিটি হয়নি৷”
তিনি জানান, ‘‘১০ ডিসেম্বরের আগে বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ে বৈঠক হয়েছে৷ সেই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা যুগপৎ আন্দোলন শুরু করেছি৷”
যুগপৎ আন্দোলনে গণতন্ত্র মঞ্চ
এদিকে গণতন্ত্র মঞ্চ বিএনপির ১০ দফাকে সমর্থন দিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের জন্য তাদের ১৪ দফা ঘোষণা করেছে সোমবার৷ তারাও বিএনপির সঙ্গে একই কর্মসূচি দিয়ে আলাদাভাবে তা পালন করবে৷ তারা ১৩ ডিসেম্বরের বিক্ষোভ কর্মসূচি এবং ২৪ ডিসেম্বরের গণমিছিল কর্মসূচি পালন করবে৷ তাদের ১৪ দফা হলো- বর্তমান সংসদ বিলুপ্ত করা, সরকারকে অনতিবিলম্বে পদত্যাগ করা, অবাধ, নিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের জন্য অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন করা, বর্তমান নির্বাচন কমিশন বাতিল করে গ্রহণযোগ্য একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করা, নির্বাচনে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড' নিশ্চিত করতে নির্বাচনে টাকার খেলা ও মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধ করা, আরপিও সংশোধন করা, প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক পরিবর্তন করা, ইভিএম পদ্ধতি বাতিল করে পেপার ব্যালটের মাধ্যমে ভোটের সুষ্ঠু ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বাতিল করা৷ এছাড়া সংসদ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা, ন্যায়পাল ও সাংবিধানিক আদালত প্রতিষ্ঠা করা, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার করে সরকার গঠনে আস্থাভোট ও বাজেট পাস ছাড়া সব বিলে স্বাধীন মতামত দেওয়ার সুযোগ করা৷
গণসংহতি অন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন,"বিএনপি এবং আমরা গণতন্ত্র মঞ্চ একটি লিয়াজোঁ কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি৷ দ্রুততম সময়ের মধ্যেই এই লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করা হবে৷ লিয়াজোঁ কমিটি যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখা ও মাঠের কর্মসূচি ঠিক করবে৷ আমরা একই দিন একই সময়ে আলাদা ব্যানারে তা পালন করব৷”
তিনি বলেন, ‘‘বিএনপি ১০ দফা দিয়েছে৷ আমাদের ১৪ দফা বিএনপিকে দিয়েছিলাম৷ কিন্তু সরকারের দমনপীড়ন বিএনপির মহাসচিবসহ শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তারের কারণে দফাগুলো নিয়ে আলোচনা শেষ হয়নি৷ লিয়াজো কমিটি তা চূড়ান্ত করবে৷ অভিন্ন দাবিনামা ও কর্মসূচি তৈরি করবে৷”
গণতন্ত্র মঞ্চে আছে সাতটি দল ৷ এগুলো হলো: আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য, সাইফুল হকের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জোনায়েদ সাকির গণসংহতি আন্দোলন, ড. রেজা কিবরিয়া ও সাবেক ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুরের গণ অধিকার পরিষদ, শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলুর ভাসানী অনুসারী পরিষদ ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন৷ আর আছে বিএনপির ২০ দলীয় জোট৷
শাসক দল আওয়ামী লীগের কৌশল
এদিকে শাসক দল আওয়ামী লীগ অনেকটাই ফুরফুরে মেজাজে আছে৷ তারা মনে করছে বিএনপির ১০ তারিখের সমাবেশের যে টার্গেট ছিলো তা ‘পুরোই ফ্লপ’৷ এর ফলে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠন চাঙা হয়েছে৷ নেতা-কর্মীরা আবার মাঠে নেমেছে৷ তারা আগামী নির্বাচনের কাজ শুরু করে দিতে চায় যাতে এই নেতা-কর্মীরা মাঠেই থাকে৷ আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, এরইমধ্যে শীর্ষ পর্যায় থেকে সম্ভাব্য প্রার্থীদের গ্রিন সিগন্যাল দিয়ে মাঠে থাকতে বলা হয়েছে৷ একইসঙ্গে বিএনপির ১০ তারিখের সমাবেশসহ বিভাগীয় ১০ সমাবেশে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো তাদের চাপের রাখতে ধারাবাহিকভাবে ব্যবহার করা হবে৷ আর বিএনপির চেয়ে মাঠ পর্যায়ে সমাবেশসহ বেশি কর্মসূচি দেয়া হবে৷
বাগে রাখতে চায় জাতীয় পার্টিকে
জাতীয় পার্টিকে বাগে আনতে সরকার সব কৌশলই কাজে লাগাচ্ছে৷ জিএম কাদের এখন মামলার মাধ্যমে ইনঅ্যাকটিভ৷ রওশন এরশাদ পুরোই সরকারের সঙ্গে আছেন৷ বিএনপির খালি হওয়া সাতটি সংসদীয় আসনও কাজে লাগানো হবে৷ জাতীয় পার্টির নেতারা এখন সঙ্গে থাকার শর্তে সাতটি আসনই চাইছে৷ তবে সরকারের দিক থেকে একটি অংশ দেয়ার চিন্তা আছে৷ কিন্তু এখনো বিষয়টি পরিষ্কার হয়নি৷ কারণ ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের খুশি করতেও উপ-নির্বাচনে দুই-একটি আসন দেয়া হতে পারে৷ জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন," আমাদের নেতারা কেউ কেউ বিচ্ছিন্নভাবে উপ-নির্বাচনে দলের প্রার্থীদের অংশ নেয়ার কথা বলেছেন৷ কিন্তু দলীয়ভাবে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি৷ উপ-নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আমরা দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নেব৷”
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘আমরা আমাদের মত করে সরকারবিরোধী আন্দোলনে আছি৷ তবে নির্বাচনের আগে কোনো জোটভুক্ত হব কী না তা বলার সময় এখনো আসেনি৷’’
সক্রিয় হচ্ছে ১৪ দলীয় জোট
আওয়ামী লীগ ১৪ দলীয় জোটকে আবার চাঙা করার উদ্যোগ নিয়েছে৷ ১০ ডিসেম্বরের আগে জোটের একটি বৈঠক হয়েছে৷ সেখানে জোট নেতারা তাদের না পাওয়ার ক্ষোভের কথা জানালেও আবার জোটগত কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে৷ সামনে যে সময় আছে সেই সময়ে তাতে খুশি করা হবে বলে জানা গেছে৷ ২৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলের পর আবার জোটের বৈঠক হবে৷
১৪ দলীয় জোটভুক্ত সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলেন, ‘‘১৪ দলীয় জোট আবার সক্রিয় হচেছ৷ ১৪ এবং ১৬ ডিসেম্বর আমরা জোটগতভাবে কর্মসূচি পালন করব৷ দেশে পলিটিক্যাল ক্রাইসিস তাই আমরা তো আর বসে থাকতে পারছি না৷ বিএনপি জোট বাড়াচ্ছে আমরাও বাড়াবো৷”
পাওয়া না পাওয়ার বেদনা নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি হেসে বলেন, ‘‘যখন জামায়াত আবার সক্রিয় হচ্ছে মাঠে নামছে তখন তো আর ওই হিসাব করে প্রগতিশীল শক্তি বসে থাকতে পারে না৷ সব সময় তো আর হিসাব চলে না৷”সরকার বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদেশিদের বাইরে চাপে এবং ভিতরে গুডবুকে রাখতে চায়৷ ১০ তারিখ বিএনপির সমাবেশের পর দিন ১১ ডিসেম্বর ঢাকায় এক সেমিনারে কূটনীতিকদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা না বলার জন্য বলেছেন পরররাষ্ট্রমন্ত্রী৷ ওই সেমিনারে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অষ্ট্রেলিয়া, সুইডেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতসহ ঢাকার প্রায় সব দূতাবাসের দূতেরা ছিলেন৷