শীর্ষ নেতৃত্বে কেন পরিবর্তন আসে না
২০ ডিসেম্বর ২০১৯শেখ হাসিনা ১৯৮১ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন৷ দেশের বাইরে থাকা অবস্থায় ওই বছর তার অনুপস্থিতিতে তাঁকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়৷ ছয় বছরের নির্বাসিত জীবন শেষে তিনি ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন৷
আর খালেদা জিয়া বিএনপির চেয়ারপার্সন ১৯৮৪ সাল থেকে৷ ১৯৮৪ সালের ১২ জানুয়ারি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন এবং একই বছরের ১০ মে চেয়াপার্সন হন৷ তিনি কারাগারে থাকায় লন্ডনে অবস্থানরত তার বড় ছেলে তারেক রহমান ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন৷ আর এরশাদ আমৃত্যু জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ছিলেন৷
এবারের কাউন্সিলেও শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি হচ্ছেন৷ কিন্তু সাধারণ সম্পাদক কে হবেন তা-ও নির্ধারণ করবেন শেখ হাসিনা৷ দলের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গত কয়েক মাস ধরে তার সাধারণ সম্পাদক পদে থাকা-না-থাকা নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ঘুরেফিরে অনেক কথা বললেও শেষ পর্যন্ত একটি কথাই বলেছেন, ‘‘সাধারণ সম্পাদক কে হবেন সেব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত৷''
গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, সারাদেশ থেকে আওয়ামী লীগের ১৫ হাজার কাউন্সিলর নেতৃত্ব নির্বাচন করতে কাউন্সিলে যোগ দিয়েছেন৷ এজন্য আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুনকে প্রধান করে নির্বাচন কমিশনও গঠন করা হয়েছে৷ আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে শেখ হাসিনা ছাড়া আর কোনো প্রার্থী নেই৷ ফলে তিনিই সভাপতি থাকছেন৷ আর প্রচলিত ধারায় কাউন্সিলররা সাধারণ সম্পাদকসহ পরবর্তী নেতৃত্ব নির্বাচন করার জন্য শেখ হাসিনাকেই (সভাপতি) সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দেন৷ এবারও তার ব্যতিক্রম আশা করছেন না কেউ৷ ফলে সভাপতিই পরবর্তী নেতৃত্ব ঠিক করবেন৷
২০১৬ সালে বিএনপির সর্বশেষ কাউন্সিলেও খালেদা জিয়া চেয়ারপার্সন পদে একক প্রার্থী ছিলেন৷ আর মহাসচিবসহ অন্যান্য নেতৃত্বও তার ইচ্ছা অনুযায়ী নির্বাচন করা হয়৷
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের এই পরিস্থিতি কেন? এর জবাবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক আফসান চৌধুরী বলেন, ‘‘ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে সবল দল হলো আওয়ামী লীগ৷ সেই আওয়ামী লীগের ভিতরেই নেতা-নেত্রীরা বলবেন, সবকিছু জানেন প্রধানমন্ত্রী৷ প্রধানমন্ত্রী আমাদের দেশে সবচেয়ে সবল প্রধানমন্ত্রী৷ কিন্তু দলের ভিতরে দ্বিতীয় কেউ নাই, যে বলতে পারেন, হ্যাঁ, আমি দ্বিতীয়৷ আর সবাই দুর্বল৷ শেখ সাহেবের কাছাকাছি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম৷ কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছাকাছি কেউ আছে এটা তো খুঁজে পাওয়া যায় না৷''
তার মতে, ‘‘দলের নেতারাও দলের ভেতরে গণতন্ত্র চান না, কারণ, তারা চান কানেকশন৷ তারা যোগাযোগের মাধ্যমে নিজের অবস্থান সংহত করতে চান৷ কারণ, এখানে মেধার ভিত্তিতে কিছু হয় না, হয় যোগাযোগের ভিত্তিতে৷''
আর বিএনপি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘আওয়ামী লীগের চেয়ে সম্ভবত বিএনপির অবস্থা আরো খারাপ৷''
এদিকে নেতৃত্ব নির্বাচনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন আরেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ৷ কিন্তু উপমহাদেশে শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতসহ আরো কয়েকটি দেশে রাজনৈতিক উত্তরাধিকারকে গুরুত্ব দেয়া হয় বলে জানান তিনি৷ তিনি মনে করেন, এর ভালো-খারাপ দুই দিকই আছে৷ খারাপ দিক হলো, নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে না৷ তবে অনেক সময় ভুল নেতৃত্ব নির্বাচনের আশঙ্কা থেকে রেহাই পাওয় যায়৷
অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, ‘‘মাঝেমধ্যে সংকটের সময় এই প্রবণতা ভাঙার চেষ্টা করা হয়েছে৷ নতুন নেতৃত্ব আনার চেষ্টা হয়েছে৷ কিন্তু সফল হয়নি৷ দেখা গেছে আর পুরনো নেতৃত্বের ওপরই নির্ভর করা হয়েছে শেষ পর্যন্ত৷''
তার মতে, এটা যে শুধু বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের প্রবণতা, তা নয়৷ এনজিও, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সংবাদমাধ্যম সবখানেই এক ব্যক্তিনির্ভরতার প্রবণতা৷ এটা একটা সামগ্রিক সংকট৷''
তবে গণতান্ত্রিক বিকাশের জন্য পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্রের জন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রচলিত ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে বলে তার অভিমত৷
আর আফসান চৌধুরীর মতে, ‘‘দলের নেতাদের দলের মধ্যে গণতন্ত্র চাইতে হবে৷যারা ধনী,তারা রাজনীতি করেন৷তারা এটা চান তাদের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য৷''
এই অবস্থা যে শুধু কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রেই, তা নয়৷ রাজনৈতিক দলগুলোর জেলা ও উপজেলা থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতৃত্ব নির্বাচন হয় সিলেকশন পদ্ধতিতে, হয় কেন্দ্রের ইচ্ছায়৷