রামসেতু কি অলৌকিক নাকি বাস্তব?
৩০ ডিসেম্বর ২০১৭বিতর্কটা আসলে শুরু হয়েছিল বছর দশেক আগে, যখনকংগ্রেস-জোট সরকারএর সত্যতা অস্বীকার করে৷ সম্প্রতি এক অ্যামেরিকান টিভি চ্যানেল দাবি করে, রামসেতু বা ‘অ্যাডামস ব্রিজ' নিয়ে করা এক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে হিন্দু পুরাণে যেটাকে রামসেতু বলা হয়েছে, তার পেছনে বৈজ্ঞানিক সত্যতা আছে৷ এমনকি তাদের দাবি, শ্রীরাম যে এই সেতু বানিয়েছিলেন তার বাস্তব প্রমাণও পাওয়া গেছে৷ মার্কিন পুরাতাত্ত্বিকদের উদ্ধৃত করে ঐ টেলিভিশন সংস্থার বিজ্ঞান বিষয়ক চ্যানেলে বলা হয়, দক্ষিণ ভারতের রামেশ্বরমের কাছে পামবন দ্বীপ থেকে শ্রীলংকার উত্তর উপকূলের মান্নার দ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ পক-প্রণালীতে চূণাপাথরের যে রেখা চলে গেছে, সেটা আদতে মানব-সৃষ্ট৷ ভূ-প্রাকৃতিক নয়৷ নাসার উপগ্রহ থেকে তোলা ছবি এবং অন্যান্য প্রমাণ উদ্ধৃত করে পুরাতাত্ত্বিকরা প্রমাণ করেছেন, এই সেতু নির্মাণে যে শিলাখণ্ড ব্যবহার করা হয়েছে তার বয়স আনুমানিক সাত হাজার বছর প্রাচীন এবং তা সংগ্রহ করা হয়েছিল অন্য জায়গা থেকে৷ জানা গেছে, অগভীর সমুদ্র গর্ভস্থ বালুরাশির বয়স হবে প্রায় চার হাজার বছর৷ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বালি এবং পাথরের প্রাচীনত্বের মধ্যে অসামঞ্জস্যতা, অর্থাৎ যে বালুরাশির ওপর শিলাখণ্ডগুলি বসানো হয়েছিল তা বালির বয়সের চেয়ে পুরনো৷ কাজেই সেটা যে মানুষের তৈরি বিজ্ঞান এই তত্ত্বই প্রমাণ করে৷ জানিয়েছেন ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব বিষয়ক ইতিহাসবিদ চেলসা রোজ৷ ভূ-তাত্ত্বিক অ্যালান লেস্টার মনে করেন, এই ধরনের দীর্ঘ সেতু বানানো অতি-মানব শক্তি ছাড়া সম্ভব নয়৷
এই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সামনে আসতেই নতুন করে দেখা দেয় বিতর্ক৷ গোড়ায় এই বিতর্ক শুরু হয় যখন মনমোহন সিং-এর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস জোটসরকার সেতুসমুদ্রম জাহাজ চলাচল প্রকল্পের কথা বলে৷ এই প্রকল্প বঙ্গোপসাগরকে আরব সাগরের সঙ্গে যুক্ত করতে মান্নার উপসাগর এবং পক প্রণালী দিয়ে জাহজ চলাচল প্রকল্পের প্রস্তাব দেয়৷ এর জন্য তামিলনাড়ু ও শ্রীলংকার মধ্যে সেতুসমুদ্রম সাগরে চূণাপাথরের চিহ্ন বরাবর ‘ড্রেজিং' করার প্রস্তাব দেওয়া হয়৷ কংগ্রেসের নির্বাচনি ইস্তেহারেও তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷ তারও আগে ১৯৫৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকার সেতুসমুদ্রম প্রকল্পের সম্ভাব্যতা খতিয়ে দেখতে এক বিশেষজ্ঞ কমিটি নিয়োগ করেছিল৷ কমিটি রামসেতু ড্রেজিং না করার পক্ষে সুপারিশ করেন৷ ২০০৫ সালে কংগ্রেস জোট সরকার প্রকল্পটির ছাড়পত্র দেয়৷ উদ্বোধনও হয়৷ কিন্তু বাধা আসে পরিবেশ সংস্থা এবং বিজেপির মতো ’হিন্দুত্ববাদী দলগুলি থেকে৷ ২০০৮ সালে কেন্দ্রীয় সরকার বিকল্প জলপথের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে এক কমিটি গঠন করে৷ ঐ কমিটি অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত দিক থেকে সেতুসমুদ্রম প্পকল্পের সম্ভাব্যতা নাকচ করে দেয়৷
পরবর্তীতে বিষয়টি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়৷ পিটিশনে দাবি করা হয় বাল্মিকীর রামায়ণ এবং তুলসীদাসের রামচরিতমানস বর্ণিত রামসেতু ভারতের এক ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য৷ তার উত্তরে কেন্দ্রীয় সরকার হলফনামা দাখিল করে৷ তাতে বলা হয়, রামসেতু পৌরাণিক হতে পারে কিন্তু ঐতিহাসিক নয়৷ রামসেতু মানব-সৃষ্ট নয়৷ আসলে ১০৩টি ছোট ছোট প্রবাল খণ্ডের জোড়াতালি৷ বিজেপি শাসক দলের বিরুদ্ধে ধর্মবিশ্বাসে আঘাত হানার অভিযোগ তুলে এই প্রকল্প বাতিল করার দাবি জানায় এবং শেষ পর্যন্ত সরকার তা মানতে বাধ্য হয়৷ তত্কালীন আইনমন্ত্রী ঘোষণা করেন, শ্রীরাম ভারতীয় সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ৷ আদালতের বিচার্য বিষয় নয়৷ হিমালয়যেন হিমালয়, গঙ্গা যেমন গঙ্গা, শ্রীরাম তেমনি শ্রীরাম৷ ধর্মবিশ্বাসই শেষ কথা৷ মার্কিন টিভি চ্যানেলে প্রচারিত অনুষ্ঠানে যা দেখানো বা বলা হয়, বর্তমান শাসক দল বিজেপি তথা হিন্দুত্ববাদীদের ধর্মীয় বিশ্বাস তাতে আরও দৃঢ় হয়েছে এবং ধর্মীয় আবেগে দেখা দিয়েছে নতুন আলোড়ন৷ হিন্দুত্ববাদীরা মনে করছেন তাদের ধর্মবিশ্বাস পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত৷
রামসেতু নিয়ে পুরাণ ও বিজ্ঞানের এই সংঘাত প্রসঙ্গে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্স-এর অধ্যাপক দেবদাস ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলের কাছে তাঁর অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, ‘‘রামসেতু বিতর্ক দেশের মানুষকে ভুলিয়ে রাখার একটা উপায়৷ হিন্দুত্ববাদী বিজেপি এবং আরএসএস চাইছে ভারতকে একটা হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করতে৷ লোকে খেতে পরতে পাচ্ছে না৷ মানব বিকাশ সূচক ১৩১ ও ১৮৮-এর মধ্যে৷ সেখানে কে রামসেতু বানিয়েছিল, কবে কোথায় গনেশের মুখ থেকে দুধ বেরিয়েছিল – এই সবই মানুষকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা৷''
সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ভট্টাচার্য আরও জানান, ‘‘এককালে মানুষ পিরামিড বানিয়েছিল, তেমনি রামসেতু যদি কেউ বানিয়ে থাকে তা আনন্দের বিষয়৷ গবেষকরা বলবেন সেটা ম্যান-মেড কিনা৷ তারসঙ্গে রামায়ণের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা৷ প্রাচীন ভারত নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁরা রামায়ণের পটভূমি নিয়ে বা ভারত-শ্রীলংকা নিয়েও একমত নন৷ রামায়ণের লংকা বলতে রাবণের লংকা বোঝানো হয়েছে৷ সেটা আজকের শ্রীলংকা কিনা তা নিয়েও কিন্তু কিছুটা মতভেদ আছে৷''
‘‘আসলে দু'টো জিনিসকে জুড়ে দেবার ফলেই বিতর্কের সূত্রপাত৷ একটা হচ্ছে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান, অর্থাৎ রামসেতু ম্যান-মেড নাকি ম্যান-মেড নয়৷ আরেকটা হলো যদি ম্যান-মেড হয়, তাহলে সেটা রামায়ণের রামসেতু কিনা৷ পৃথিবীর কোনো পুরাতাত্ত্বিক সেটা বলবেন বলে আমার মনে হয় না৷ এই জুড়ে দেবার কাজটা করছে হিন্দুত্ববাদীরা৷ তাদের আসল উদ্দেশ্য মানুষের ধর্মীয় ভাবাবেগকে উসকে দেওয়া৷ আসল ‘অ্যাজেন্ডা' থেকে দূরে সরিয়ে রাখা৷'' ডয়চে ভেলেকে সোজা সাপ্টা ভাষায় বললেন সমাজবিজ্ঞানী দেবদাস ভট্টাচার্য৷
উল্লেখ্য, পুরাণে আছে লংকার রাক্ষস-রাজা রাবণের রাজ্যে প্রবেশ করতে হাজার হাজার বছর আগে ভগবান রামচন্দ্র এবং তাঁর বানর সেনা বানিয়েছিল এই সেতু৷ বাল্মিকি রচিত হিন্দু মহাকাব্য রামায়ণে বর্ণিত আছে বানর সেনা শ্রীলংকায় প্রবেশ করেছিল শ্রীরামের স্ত্রী সীতাকে উদ্ধার করতে, যাঁকে অপহরণ করে লংকায় নিয়ে যায় রাক্ষস-রাজা রাবণ৷
বন্ধু আপনার কী মনে হয়? এই রামসেতু আদতে অলৌকিক নাকি বাস্তব? লিখুন নীচের ঘরে৷