রাসায়নিক রাখার তথ্য ‘না দেওয়ায়' এতো মৃত্যু
৮ জুন ২০২২বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষ হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড কিংবা রাসায়নিক থাকার তথ্য ‘না দেওয়ায়' পানি দিয়ে আগুন নেভাতে গিয়ে কর্মীদের হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে বলে জানিয়েছে অগ্নিনির্বাপণ সংস্থার কর্মকর্তারা ৷
সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ির বিএম ডিপোতে শনিবারের আগুন এবং বিস্ফোরণের ঘটনায় ৪১ জনের মরদেহ পাওয়া গেছে ৷ মঙ্গলবার মিলেছে আরও দুটি দেহাবশেষ ৷ আহত হয়েছেন দুই শতাধিক মানুষ ৷ এর মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের ৯ জন নিহত, ৩ জন নিখোঁজ এবং ১৫ জন আহত হয়েছেন ৷
ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক মো. আনিসুর রহমান ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘ডিপো কর্তৃপক্ষ ঘটনার দিন এমন কোনো তথ্য দেননি যে এখানে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড বা এ জাতীয় কোনো রাসায়নিক আছে যা বিস্ফোরণ ঘটতে পারে৷
‘‘সেটা জানা না থাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে কুমিরা ও সীতাকুণ্ড এই দুই স্টেশনের আমাদের জনবল, অফিসার এবং গাড়ি সবকিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৷ ’’
মঙ্গলবার পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের ৯ কর্মীর মৃত্যু হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, "আমাদের আরও ৩ জন এখনো মিসিং৷ আজ সকালে আমরা আরও দুটি দেহাবশেষ উদ্ধার করেছি৷ এর মধ্যে আলামত দেখে মনে হচ্ছে একজন আমাদের কর্মী৷ ’’
ফায়ার সার্ভিসের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড বা কোনো রাসায়নিক আছে এ তথ্য জানা না থাকায় আমাদের কর্মীরা পানি দিয়ে আগুন নেভাতে গিয়েছিল৷
‘‘সেখানে যে শেডটি পুড়ে গেছে তাতে বিপুল পরিমাণ ঝুট কাপড় ছিল ৷ সেখান থেকেই আগুনের সূত্রপাত বলে প্রাথমিকভাবে জেনেছি ৷ ওই শেডের পাশেই ছিল হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের কন্টেইনার ৷ ’’
ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা বলেন, ‘‘ঝুটের আগুনে ওই কন্টেইনারে থাকা হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড উত্তপ্ত হচ্ছিল ৷ আমাদের কর্মীরা যখন পানি ছিটাতে শুরু করেছিল তখন তারা জানতো না কোন কন্টেইনারে কী আছে৷
‘‘সাধারণ আগুন ভেবেই তারা পানি দিয়ে নেভাতে গিয়েছিল ৷ এর মধ্যে একটি কন্টেইনারে পানি ছিটাতে শুরু করার ১ মিনিট ৪৭ সেকেন্ডের মাথায় বিস্ফোরণটি ঘটে ৷ ’’
বিভিন্ন ফেসবুক লাইভ ভিডিওতে দেখা গেছে, শুরুতে আগুন ছিল স্বল্প পরিসরে ৷ শেডের পাশে কয়েক সারিতে কন্টেইনারগুলো একটির ওপর একটি করে রাখা ছিল ৷ একেক সারিতে উপরের দিকে ৪-৫টি করে কন্টেইনার ছিল ৷
ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, ইয়ার্ডের দক্ষিণ অংশে শেড লাগোয়া সারির একসঙ্গে কয়েকটি কন্টেইনারে আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিসের দুটি গাড়ি নিয়ে কর্মীরা পানি ছিটাচ্ছিল ৷ শুরুতে কয়েকটি কন্টেইনার লক্ষ্য করে পানি ছিটালেও আগুন কমেনি ৷ পরে আরেকটি কন্টেইনার লক্ষ্য করে পানি ছিটাতে শুরু করার কিছুক্ষণ পরই বিকট বিস্ফোরণ হয়৷ ওই বিস্ফোরণে আশেপাশে থাকা বেশিরভাগ মানুষকে ছিটকে পড়ে যেতে ভিডিও চিত্রে দেখা যায়৷
বিএম ডিপোতে উদ্ধার কাজে অংশ নেওয়া স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গাউছিয়া কমিটির সদস্যরা জানান, পুড়ে যাওয়া শেড এবং ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির আশেপাশ থেকেই ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের মরদেহের বেশিরভাগ উদ্ধার করা হয়েছে৷
ফায়ার সার্ভিসের কুমিরা ও সীতাকুণ্ড স্টেশনের যে দুটি গাড়ি শনিবার শুরুতে আগুন নেভাতে গিয়েছিল সে দুটিই মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ এরমধ্যে একটি গাড়ি ডিপো থেকে সরিয়ে নেওয়া হলেও অন্যটি এখনো ডিপোর ভেতরেই আছে৷ মঙ্গলবার উদ্ধার করা দুটি দেহাবশেষের একটি ওই ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির কাছ থেকেই উদ্ধার করা ৷
ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক মো. আনিসুর রহমান বলেন, ‘‘ডিপোতে শুধু গার্মেন্টস পণ্য ছিল না ৷ এর বাইরে খাদ্যপণ্য, বিভিন্ন কাঁচামাল এবং গার্মেন্টস এক্সেসরিজও ছিল যা আগুনের জন্য সহায়ক৷
‘‘এ ধরণের অবকাঠামোতে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক থাকলে এর নিরাপত্তায় নিজস্ব ব্যবস্থাপনা থাকতে হয় ৷ পাশাপাশি কর্মীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থাও রাখতে হয় ৷ ’’
বিএম ডিপোতে এমন নিরাপত্তা ছিল কি না জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘‘নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল কি না তা আমাদের তদন্ত কমিটি অনুসন্ধান করে দেখবে ৷” তবে অগ্নি নির্বাপনে নিয়োজিত একাধিক সংস্থার কর্মীরা নিশ্চিত করেছেন, ওই ডিপোতে কোনো ফায়ার হাইড্রেন্ট ছিল না ৷ যা এরকম বড় অবকাঠামোতে আগুন নেভাতে প্রয়োজনীয়৷
বিএম ডিপোর মালিক পক্ষ স্মার্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপক (অ্যাডমিন) মেজর (অব.) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘‘হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড আমদানি-রপ্তানি পণ্য ৷ দেশের ৬টি কোম্পানি এটি উৎপাদন করে৷
‘‘স্বাভাবিকভাবে অন্যান্য পণ্যের মত এটিও ডিপোতে শুল্কায়ন শেষে বন্দরের মাধ্যমে রপ্তানি হয় ৷ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আমাদের ডিপোর মাধ্যমেও পণ্যটি রপ্তানি হয়ে আসছে ৷ ’’
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘‘এখানে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের একটি অফিস আছে৷ তারা ডিপোতে আমদানি-রপ্তানি কাজে সার্বক্ষণিক তদারকি করেন ৷ তাদের অনুমতি ব্যতীত কন্টেইনার তো দূরের কথা এক কেজি পণ্যও ডিপোতে প্রবেশ কিংবা বের করা অসম্ভব৷
‘‘ডিপোতে হাজার হাজার কন্টেইনারের মধ্যে মাত্র একটি কন্টেইনারের বিস্ফোরণ হওয়া রহস্যজনক ৷ ডিপো কর্তৃপক্ষ এ ঘটনার একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত চায়৷ ’’
তবে ডিপোর অগ্নি নিরাপত্তা বিষয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে কিছু উল্লেখ নেই৷ তবে ডিপোতে অগ্নি নির্বাপনের সব রকম সরঞ্জাম ও প্রস্তুতি ছিল বলে রোববার জানিয়েছিলেন বিএম ডিপোর জিএম (সেলস ও মার্কেটিং) নাজমুল আকতার খান৷
এনএস/কেএম (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)