1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

খাবারে সীসা, শরীরে ঢুকছে বিষ!

পায়েল সামন্ত কলকাতা
২৫ জানুয়ারি ২০১৮

বাতাসের মাত্রাতিরিক্ত সীসায় দূষিত হচ্ছে রাস্তার ফাস্ট ফুডের সম্ভার৷ শুধু ফাস্ট ফুড নয়, কলকাতার খোলা বাজারে চাল, ডাল, মশলা, কাঁচা সবজি, মাছ, মাংস — সবেতেই মিলছে মাত্রাতিরিক্ত সীসা৷ তবে কি নিশ্চিন্ত মনে খাওয়ার দিন শেষ?

https://p.dw.com/p/2rV1T
Indien Straßenküche in Kalkutta
ছবি: DW/Payel Samanta

শুরুটা হয়েছিল বহুজাতিক কোম্পানির ইনস্ট্যান্ট নুডলস দিয়ে৷ খাদ্যদ্রব্যে সীসার উপস্থিতি নিয়ে নড়েচড়ে বসেছিল প্রশাসন৷ কিন্তু প্রতিদিনই নানাভাবে আমাদের শরীরে ঢুকছে সীসার বিষ৷ রাস্তার ধারে সাজিয়ে রাখা কাটা ফল হোক বা ফুচকা, ঝালমুড়ি কিংবা ডাল-ভাত — খোলা হাওয়ার সংস্পর্শে এসে সবটাই হয়ে উঠছে সীসার ভাণ্ডার৷ কিছুদিন আগের জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার সমীক্ষায় উঠে আসে এমনই চাঞ্চলকর তথ্য৷ কিন্তু তাতে কতটা সতর্ক হয়েছেন ক্রেতা ও বিক্রেতারা? বিশেষজ্ঞরাই বা কী বলছেন?

সমীক্ষায় দেখা গেছে, কলকাতার রাস্তার ধারে বিক্রি হওয়া খাবার থেকে শুরু করে কাঁচা সবজিতে সীসার পরিমাণ উদ্বেগজনক৷ চাল, মুসুর ডাল, মুরগির মাংস, আঁশ ছাড়া মাছ, গুঁড়ো মশলা, বিস্কুট ইত্যাদির নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল কলকাতার ১২টি বাজার থেকে৷ দেখা যাচ্ছে, এ সব নমুনায় প্রতি কেজিতে গড়ে ২৩ দশমিক ৫৬ মিলিগ্রাম সীসা রয়েছে৷ অথচ ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডের হিসেব অনুযায়ী, প্রতি কেজি খাবারে ২ দশমিক ৫ মিলিগ্রাম পর্যন্ত সীসার পরিমাণ মানুষের শরীর সহ্য করতে সক্ষম৷ বিশিষ্ট হেমাটোলজিস্ট ড. আর এন ঘোষ জানালেন, খাদ্যে দূষণ থেকেই রক্তে রোগ দানা বাঁধে৷ সীসার উপস্থিতিতে তা আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে৷ নীলরতন সরকার হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক এন এম বিশ্বাসের মতে, খাদ্যে সীসার উপস্থিতির দরুণই কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা বাড়ে৷

বুবাই পণ্ডিত

শুরু হয় পাইলস, ফিসচুলার সমস্যাষ নিয়মিত সীসাযুক্ত খাবার খেলে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা বা আলসার হওয়া স্বাভাবিক৷ এছাড়া লিভার বা কিডনির রোগ তো বাড়বেই৷ ডাক্তার বিশ্বাস শহরের বুকে কিডনির রোগের এত প্রকোপের জন্য রাস্তার যথেচ্ছ খাবার খাওয়াকেই দায়ী করেছেন৷ কলকাতার হাসপাতাল চত্বরগুলিতে খেয়াল করে দেখা গেল, ভাতের হোটেল থেকে শুরু ফলের রসের ছাউনি সবই রয়েছে একেবারে রাস্তার ধারেই৷ সীসার দূষণযুক্ত খাবার খাচ্ছেন রোগী ও রোগীর পরিজনেরা৷

গার্ডেন রিচ, গড়িয়াহাট, খিদিরপুর, টালিগঞ্জ প্রভৃতি জনবহুল জায়গা থেকে সংগৃহীত বিভিন্ন নমুনার পাশাপাশি ধাপা-সহ ইএম বাইপাস সংলগ্ন এলাকার মাটি ও জলও সংগ্রহ করা হয়েছে৷ দেখা গেছে, কলকাতার রাস্তার ধুলোয় সীসা যেমন উদ্বেগের কারণ, তেমনি বর্জ্যভূমি ধাপার মাটিতে মিশে রয়েছে সীসার বিষ৷ ফলে এর থেকে নিষ্কৃতি মিলছে না ফুলকপি, মুলোর মতো সবজিরও৷ আবার পিকনিক গার্ডেনের ব্যাটারি শিল্পের সীসা মিশছে পূর্ব কলকাতার জলাশয়গুলিতে৷ এতে ধাতব পদার্থটি পাওয়া যাচ্ছে মাছ-সহ বিভিন্ন জলজ প্রাণীর দেহে৷ এভাবেই মানব শরীরে পৌঁছে যাচ্ছে ক্ষতিকর ধাতু সীসা৷ ডায়েটিশিয়ান ঈশানী বন্দ্যোপাধ্যায় এ জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করেছেন জলকে৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি জানালেন, ‘‘সীসার দরুণ মানব শরীরে কিডনি ও নার্ভের ওপর চাপ পড়ে৷ টক্সিক প্রভাবও থাকে৷ তবে শুধু ‘স্ট্রিট ফুড' নিয়ে ভাবলে চলবে না৷ সীসাযুক্ত খাবার বাড়িতেও ঢুকছে৷ সেটা বাড়িতেও রান্না করছে৷ জলের মধ্যে উপস্থিত সীসাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত৷ পিভিসি পাইপ না ব্যবহার করলে জলের সীসা দূষিত করছে সমস্ত কিছুই৷ সেই জল দিয়ে রাস্তার খাবারও তৈরি হচ্ছে তো! তবে রাস্তার সব খাবার খেলেই সীসা শরীরে ক্ষতি করছে, এমনটা বলা যায় না৷ কী খাওয়া হচ্ছে, কতটা খাওয়া হচ্ছে, সেটা আগে দেখতে হবে৷''

রীতা সাহা

কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে রাস্তার ধারের হোটেলে প্রতিদিন হাজার-হাজার মানুষ খাবার খান৷ তাঁরা যেটা খাচ্ছেন, সেটা নিয়ে অনেকে আদৌ ভাবিত নন৷ জিএসআই সমীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্য দেখাচ্ছে, সীসা সমৃদ্ধ খাবারের প্রায় ৭৫ শতাংশই বিক্রি হয় কলকাতার জনবহুল রাস্তায়৷ শহরের রাস্তায় বিক্রি করা ভাজাভুজিতে সীসার মাত্রা কেজি প্রতি ৪ দশমিক ৮২ থেকে ১০ দশমিক ৭১ মিলিগ্রাম৷ অন্যতম জনবহুল এবং দামি এলাকা বলে পরিচিত দক্ষিণ কলকাতার গড়িয়াহাটে বিক্রি হওয়া ফাস্ট ফুডে সীসার দূষণ সবচেয়ে বেশি৷

এই অঞ্চলের স্ট্রিট ফুড চত্বরে ডয়চে ভেলের মুখোমুখি খাদ্যরসিকদের অনেকেই জানালেন, খাবারে যে সীসা থাকতে পারে, এ সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই নেই৷ অনেকে জেনেও সতর্ক হতে পারছেন না৷ কারণ রাস্তায় সবসময় বাড়ির খাবার বহন করা সম্ভব নয়৷ তাই রাস্তার খাবারের উপরেই নির্ভরশীল হতে হয়৷ এ ব্যাপারে পকেটের সামর্থ্যের কথাও মাথায় রাখতে হয়৷ তাই পরিচ্ছন্ন রেস্তোরাঁ নয়, রাস্তার খাবারই বেশি নির্ভরতার জায়গা অধিকাংশ মানুষের৷ লেক গার্ডেন্সের শঙ্কর বিশ্বাস, দমদমের দেবিকা নন্দীর সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেল৷

সরকার ব্যবস্থা নিলে সমস্যা দূর করা সম্ভব, এমন ধারণা কলকাতার অনেকরেস্তোরাঁ মালিকের৷ ধর্মতলার অত্যন্ত জনবহুল এলাকায় অবস্থিত সুরুচি রেস্তোরাঁর কর্ণধার সমীর রায় জিএসআই সমীক্ষায় প্রাপ্ত খাদ্যে সীসার উপস্থিতির কথা মেনে নিয়ে রাজ্যে বায়ুদূষণ এবং সচেতনতার অভাবকেই দায়ী করলেন৷ তাঁর বক্তব্য, ‘‘ডিজেলচালিত গাড়ি বিশেষ করে অটোর তাণ্ডবে এই চত্বরে নিঃশ্বাস নেওয়া যায় না৷ এগুলিই যখন খাবারে মিশছে, খাবার বিষাক্ত হচ্ছে৷ সরকার এ দিকটা নিয়ন্ত্রণ করলে সুরাহা হতো৷ এলপিজি বা ব্যাটারি চালিত গাড়ি আরও দরকার৷ বাইক জাতীয় যানের ব্যবহার কমিয়ে ইরিক্সা, রিক্সা বা সাইকেলের মতো পরিবেশবান্ধব যানকে উৎসাহিত করা হচ্ছে না কেন?''

কলকাতার স্টিট ফুডের তীর্থভূমি, ঐতিহ্যশালী ডেকার্স লেন৷ রাজভবনের কাছেই শহরের প্রিয় এই খাদ্যগলি৷ এখানকার সবচেয়ে নামি চিত্তবাবুর দোকানের সামনে পাতা বেঞ্চ মূলত মাটন স্টু ও ডিমের ডেভিলের জন্য কখনও খালি পড়ে থাকে না৷ দোকানের ম্যানেজার বুবাই পণ্ডিতের দাবি, ক্রেতাদের স্বাস্থ্যসম্মত ও বিশুদ্ধ আহার দেওয়ার চেষ্টা তাঁরা সাধ্যমতো করেন৷ কিন্তু বাতাসে সীসা মিশে থাকলে তাঁরা কী করতে পারেন? তিনি বলেন, ‘‘বিভিন্ন অ্যারোম্যাটিক গুঁড়ো মশলাতে ক্ষতিকর পদার্থ থাকে৷ আমাদের রান্নায় এ সব ব্যবহার হয় না৷ শিলে বাটা প্রাচীন পদ্ধতিতে রান্না হয়৷ গাড়ির ধোঁয়া থেকে যে সীসা নির্গত হয়, তা আমরা কীভাবে আটকাব?''

খাবারে যে সীসা মিশছে বাতাস থেকেই, সে কথাই উঠে এল কেন্দ্রীয় দূষণ পর্যদের বিজ্ঞানী ড. রীতা সাহার বক্তব্যে৷ তিনি জানালেন, ‘‘রাস্তার খাবারে সীসা আজ নতুন নয়৷ অনেক দিন ধরেই এটা রয়েছে৷ গাড়ির ধোঁয়া থেকে রাস্তার তৈরি খাবারে ধাতব বিষ মিশছে৷ এমনিতে বাতাসে সীসা তো থাকেই৷ সে জন্যই শাক-সবজিতে তার পরিমাণটা বাড়ছে৷'' তাই সীসাহীন পেট্রোল ব্যবহারের পক্ষে তিনি৷

প্রতিবেদনটি সম্পর্কে আপনার মন্তব্য জানান, লিখুন নীচের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য