শৈশবে ফেরা
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪রূপকথার লেখক গ্রিম ভাইদের নিয়ে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকার যে অনলাইন তথ্যভাণ্ডার, তার শুরুতে একটি অসাধারণ মুখবন্ধ রয়েছে৷ অসাধারণ, কিন্তু খুব সহজ সরল৷ পাতা জোড়া এক জঙ্গলের ছবি৷ গহিন জঙ্গল৷ তার মধ্যে হঠাৎ কোথা থেকে কারুকাজ করা ছোট একটি সিন্দুক হাজির হয়৷ একটি সিন্দুক আর একটি নকশাকাটা চাবি৷ লেখা ফুটে ওঠে, গভীর জঙ্গলের মধ্যে আপনি একটি সিন্দুক খুঁজে পেয়েছেন৷ চাবি দিয়ে সেই সিন্দুকের ডালা খুললেই আপনি পাবেন এক মহা ঐশ্বর্য৷ তার নাম কল্পনা৷ গ্রিম ভাইদের রূপকথা আমাদের সেই ঐশ্বর্যেরই খোঁজ দেয়, শুধু শৈশব বা কৈশোর নয়, আমাদের বাকি জীবনের জন্য৷
আদতেই, আমরা প্রত্যেকে ছোটবেলায় যে যে রূপকথা শুনে মুগ্ধ হয়েছি, যেসব গল্প আমাদের মনকে কল্পনার পাখা মেলতে উৎসাহ দিয়েছে, সেই সব গল্পই গ্রিম ভাইদের লেখা৷ যেমন ‘আশেনপুটেল' বা সিন্ডারেলা, যার সৎ মা আর সৎ বোনেরা অনেক কষ্ট দিলেও একদিন ঠিকই তার স্বপ্নের রাজকুমার এসে তাকে নিয়ে যায়৷ অথবা সেই সাত বামন আর রাজকুমারীর গল্প ‘শ্নেভিটশেন' বা স্নো হোয়াইট৷ কিংবা সেই ব্যাং রাজকুমার অথবা ছোটবেলায় প্রথম মনে অ্যাডভেঞ্চারের বীজ বপন করে দেওয়া হেনসেল এবং গ্রেটেল নামে দুই ভাইবোনের গল্প৷ এসবই গ্রিম ভাইদের কলমে আঁকা চরিত্র, যা জার্মানি থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বজুড়ে৷
ইয়াকব আর ভিলহেল্ম গ্রিম ছিলেন জার্মানির হানাউ শহরের বাসিন্দা দুই ভাই৷ শিশু এবং কিশোরদের জন্য জার্মানিতে প্রচলিত নানা উপকথাকে গল্পের আকারে লিখে ফেলাই শুধু নয়, শিক্ষার বিস্তার, ভাষাতত্ত্বের গবেষণা, বিভিন্ন লোকায়ত সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণার মতো নানা বিষয় নিয়ে দুই ভাই ব্যস্ত থেকেছেন আজীবন৷ তাঁদের হাত ধরে জনপ্রিয় হওয়া বহু রূপকথার রাজ্য এখনও রয়েছে জার্মানিতে, আমাদের সবার শৈশবের কল্পনার রোমাঞ্চ গায়ে মেখে, যা পর্যটক গন্তব্য হিসেবে পরিচিত করতে উদ্যোগী হয়েছে ভারতে জার্মান জাতীয় পর্যটন দপ্তর৷
ওদের নিজস্ব পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৬ সাল পর্যন্ত যাঁরা ভারত থেকে জার্মানি সফরে গিয়েছিলেন, তাঁদের ৯৫ শতাংশই গিয়েছিলেন ব্যবসার কাজে৷ ২০০৬ সালের পর থেকে প্রবণতাটা একটু একটু করে বদলেছে৷ পর্যটক গন্তব্য হিসেবেও জার্মানি ক্রমশ জনপ্রিয় হয়েছে ভারতীয়দের কাছে৷ কিন্তু সম্প্রতি ভারতীয় টাকার অবমূল্যায়ন ঘটায় পর্যটকদের সংখ্যা সেই হারে বাড়ছে না, যতটা বেড়েছিল ২০০৭ এবং ২০০৮ সালে৷ এই দুবছরে ভারতীয় পর্যটকদের হার বাড়ছিল ১৫ থেকে ১৮ শতাংশ হারে, যেটা ২০১৩ সালে কমে দাঁড়িয়েছে পাঁচ শতাংশে৷ কিন্তু ডলার বা ইউরোর তুলনায় টাকার বিনিময় মূল্য ফের ক্রমশ স্থিতি পেতে থাকায়, ২০১৪ সালে জার্মানিতে ভারতীয় পর্যটক যাওয়ার হার অন্তত ১০ শতাংশ বাড়বে বলে আশা করছে জার্মান জাতীয় পর্যটন দপ্তর৷ এ কারণে কলকাতা-সহ ভারতের বড় শহরগুলিতে একটি রোড শোয়ের আয়োজন করেছিল তারা, যেখানে তুলে ধরা হল জার্মানির ওই রূপকথার পথ ‘মেয়ারশেনস্ট্রাসে'-কে৷
গ্রিম ভাইদের নিজেদের শহর হানাউ থেকে এই রূপকথার পথের শুরু, ৬০০ কিমি পাড়ি দিয়ে কাসেল শহর হয়ে যে পথ গিয়ে শেষ হচ্ছে ব্রেমেন শহরে৷ এই পথের দুধারেই আছে গ্রিম ভাইদের গল্পে পড়া সিন্ডারেলা, রাপানজেল, স্লিপিং বিউটি-র প্রাচীন শহর, দুর্গ আর প্রাসাদ এবং জঙ্গল, প্রকৃতি৷ এই রূপকথার পথের সফরকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে সবকটি জায়গাতেই পুতুল নাচ, বাজনার আসর, গল্প বলার আসর এবং পথনাটিকা হবে৷ যেমন হামেলন বা উপকথার হ্যামলিন শহরে এক বাঁশুরিয়া পর্যটকদের গাইডের কাজ করবেন৷ গল্পে ঠিক যেমন বাঁশিওয়ালার যাদুকরী সুরে মোহিত হয়ে তাঁর পিছু পিছু ঘুরত ছোট ছেলে-মেয়েরা, ঠিক তেমনিভাবেই৷ এবং পর্যটকদের সঙ্গে থাকবে ইঁদুরের সাজে একদল বাচ্চা৷
এই রূপকথার পথেই পড়বে হেসে রাজ্যের আল্সফেল্ড শহরে ১৬২৮ সালে তৈরি হওয়া জার্মানির ‘মেয়ারশেনহাউস' বা রূপকথা ভবন, যেখানে রয়েছে গ্রিম ভাইদের সব রূপকথার চরিত্রদের মানুষপ্রমাণ মূর্তি৷ পর্যটকরা যাবেন লান নদীর উপর মধ্যযুগীয় মারবুর্গ দূর্গ, যেখানে নাকি রাজপুত্রের সঙ্গে মহাসুখে ঘর সংসার করত সিন্ডারেলা৷ স্লিপিং বিউটির প্রাসাদ রয়েছে সাবাবুর্গ শহরে৷ আর রয়েছে নয়শোয়ানস্টাইন-এর বিখ্যাত সেই দূর্গ, যার আদলে ডিজনিল্যান্ডের সেই বিখ্যাত রূপকথার রাজপ্রাসাদ বানিয়েছিলেন স্বয়ং ওয়াল্ট ডিজনি৷