রোজায় ভোগ্যপণ্যের সংকট কি এড়ানো যাবে?
১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩বাংলাদেশে রমজান এলেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ে৷ সেখানে এবার রোজার আগেই বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়তি৷ রমজানে চাহিদা বাড়ে এমন পণ্যের আমদানিও গত বছরের তুলনায় কমেছে৷ তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে পণ্য আমদানির জন্য পর্যাপ্ত এলসি খোলা হয়েছে৷ তাই সংকট তৈরি হবে না৷ একই আশ্বাস দিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রীও ভোক্তাদের একসাথে বেশি পণ্য না কেনার আহ্বান জানাচ্ছেন৷ ভোক্তা অধিকারকর্মীরা মনে করেন সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ সবচেয়ে জরুরি৷
বাড়ছে ভোগ্যপণ্যের দাম
মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশে রোজা শুরু হচ্ছে৷ প্রায় দেড় মাস বাকি থাকলেও গত দুই সপ্তাহে মুরগি ও ডিমের দাম শতকরা ২৫ ভাগ বেড়েছে৷ প্রতিদিনই তা ক্রমাগত বাড়ছে৷
দুই সপ্তাহ আগে মুরগির প্রতি ডিমের দাম ছিল নয় টাকা৷ এখন তা ১২ টাকা৷ এক কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম ছিলো ১৬০ টাকা৷ তা বেড়ে হয়েছে ২১০ টাকা৷ একইভাবে সব ধরনের মাছের দাম বেড়েছে কেজিতে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ৷
কাঁঠাল বাগান বাজারের মাছ বিক্রেতা রতন মিয়া জানান, মাছের দাম প্রতিদিনই বাড়ছে৷ রোজায় আরো বাড়বে৷ কারণ তখন চাহিদা আরো বেড়ে যাবে৷ কম দামের পাঙ্গাস ও তেলাপিয়াও নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে৷’’ তার দাবি, ‘‘সরবরাহ কম তাই মাছের দাম বাড়ছে৷ আর সব কিছুর দাম বাড়ায় মাছের দামও বাড়ছে৷ একটা বাড়লে আরেকটা বাড়ে৷’’
কলাবাগানের মুরগি বিক্রেতা আবুল হোসেন বলেন, ‘‘ব্রয়লার মুরগির দাম প্রতিদিনই বাড়ছে, গত একদিনে বেড়েছে কেজিতে ১০টাকা৷ সোনালী মুরগির দাম এক সপ্তাহে ২৮০ টাকা কেজি বেড়ে ৩২০ টাকা হয়েছে৷”
কমেছে আমদানি
রোজায় সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে ভোজ্যতেল, চিনি, ডাল, ছোলা, খেজুর ও পেঁয়াজের৷ রোজার আগে তাই এই ছয়টি ভোগ্যপণ্যের আমদানি বাড়ে৷
কিন্তু চলতি অর্থবছরের নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি মাসে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এসব পণ্য আমদানি কমেছে ২৫ থেকে ৫০ শতাংশের বেশি৷
ডলার সংকটের কারণে এলসি খোলায় সমস্যা হওয়ায় কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে বলে জানা গেছে৷পর্যাপ্ত আমদানি না হওয়ায় বাজারে সেগুলো দাম বৃদ্ধির শঙ্কা দেখা দিয়েছে৷
গত বছর রমজানে ছোলার দাম ছিলো প্রতি কেজি ৭০ টাকা৷ এখন রোজা শুরুর আগেই কেজি ৯০ থেকে ৯৫ টাকা৷
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বর থেকে জানুয়াারি পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার ৭০৫ মেট্রিক টন৷ এক বছর আগে একই সময়ে সয়াবিন তেল আমদানির পরিমাণ ছিল দুই লাখ ২৩ হাজার ৩৮৪ মেট্রিক টন৷
এলসি খোলার পর বাইরে থেকে পণ্য আমদানি করতে এক থেকে দেড় মাস সময় লাগে৷ গত তিন মাসে ছোলার আমদানি কমেছে শতকরা ৫০ ভাগ৷ তবে চিনির আমদানি স্বাভাবিক আছে৷ তারপরও দাম বাড়ছেই৷
আমদানি কমেছে খেজুরেরও৷ গত তিন মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে খেজুর আমদানি হয় ২২ হাজার মেট্রিক টন৷ গত বছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছিলো ৪০ হাজার মেট্রিক টন৷
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি এই দুই মাস এবং পরবর্তী রোজার এক মাসের চাহিদা অনুযায়ী ওই ছয়টি পণ্য আমদানিতে ১৫৩ কোটি মার্কিন ডলারের প্রয়োজন৷ আর শুধু রোজার এক মাসের চাহিদা পূরণে এসব পণ্য আমদানিতে প্রয়োজন ৫৬ কোটি মার্কিন ডলার৷ কিন্তু ডলার সংকটের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কড়াকড়ি আরোপে এবার ব্যবসায়ীরা পর্যাপ্ত এলসি খুলতে পারেননি৷
বিশ্ববাজারে দাম কমার সুফল কি মিলবে?
টিকে গ্রুপের পরিচালক মোস্তফা হায়দার বলেন, ‘‘পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হচ্ছে৷ রোজার পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছুটা অগ্রাধিকার দিচ্ছে৷ আমরা আগ্রাধিকার ভিত্তিতে এলসি খুলতে পারছি৷ তবে নভেম্বর জানুয়ারিতে এই সুবিধা ছিল না৷ ফলে রমজানে গতবারের মত আমদানি করা পণ্যের সরবরাহ থাকবে না৷”
তিনি জানান, বিশ্ব বাজারে ভোজ্যতেলসহ আরো কিছু ভোগ্যপণ্যের দাম কমেছে৷ তবে এর প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে কিনা তা নিশ্চিত করতে পারেননি তিনি৷ বলেন, ‘‘বাংলাদেশের বাজারে দাম কেমন হবে তা নির্ভর করছে চাহিদা ও সরবরাহের উপরে৷ চাহিদার তুলনায় পণ্য কম হলে দাম বাড়তি হবে৷''
এদিকে খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে সেখানেও আমদানি করা পণ্যের সবরাহ কম৷
বাংলাদেশ ব্যাংক যা বলছে
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, রমজানে খেজুর, সয়াবিন তেল, চিনিসহ যেসব নিত্যপণ্য ভোক্তাদের বেশি প্রয়োজন হয়, সেগুলোর জন্য পর্যাপ্ত এলসি খোলা হয়েছে৷
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক ২ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের হিসেব দিয়ে এই কথা বলেছেন৷ তার মতে, ‘‘যদি পণ্য সরবরাহ ও সাপ্লাই চেইন নিবিড়ভাবে তদারকি নিশ্চিত করা যায়, পণ্যগুলো যখন যেখানে প্রয়োজন সেখানে সহজভাবে সরবরাহ করা যায়, তাহলে রোজার মধ্যে কোনো পণ্যের ঘাটতি হবে না৷”
তিনি আরো বলেন," বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় আমরা বাজার মনিটরিং করছি৷ যখন যে জায়গায় যে ধরনের নীতি সহায়তা দরকার হচ্ছে, তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক দিচ্ছে৷ এলসির ক্ষেত্রে আরও কোনো সহযোগিতা দরকার হলে তা করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক৷”
সিন্ডিকেট বন্ধের আহ্বান
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘‘বাংলাদেশ ব্যাংক যে তথ্য দিচ্ছে তাতে রমজানে আমদানি করা পণ্যের সংকট হওয়ার কথা নয়৷ তবে আমদানি পণ্যের সিন্ডিকেট আছে৷ কয়েকজন আমদানিকারক বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন৷ তাই তাদের এই সিন্ডিকেট বন্ধ করতে পারলে সংকট হওয়ার আশঙ্কা নেই৷ যখন ডলার সংকট বা এলসি খোলায় সংকট ছিল না তখনও তো তারা সংকট তৈরি করেছে৷ তাই এই সিন্ডিকেটকেই নজরে রাখতে হবে৷''
এদিকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সী রমজান মাসের জন্য সব পণ্য এক সঙ্গে না কেনার আহ্বান জানিয়েছেন ক্রেতাদের৷ তিনি বলেছেন, "রমজানের প্রথম সপ্তাহে ক্রেতারা যেভাবে বাজারে হুমড়ি খেয়ে পড়েন, সেটা থেকে সবাইকে বিরত থাকতে হবে৷ দোকানে যখন ১০০ কেজি মাল থাকে, তখন যদি ১০ জন ক্রেতার প্রত্যেকে একসঙ্গে ১০০ কেজি করে কিনতে চায় তখন মনে হয় সংকট, যেটা আর্টিফিশিয়াল সংকট৷”