রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইসলামপন্থিদের ভণ্ডামি
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭মিয়ানমারে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা হত্যার নিন্দা জানিয়েছে তুরস্ক, পাকিস্তানসহ প্রায় সব মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ৷ দেশটির পশ্চিমের রাজ্য রাখাইনে সেনা অভিযানে শত শত রোহিঙ্গার মৃত্যু এবং ফলশ্রুতিতে তিন লাখ রোহিঙ্গার দেশ ছেড়ে পালানোর ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন ইসলামি রাষ্ট্রগুলোর নেতারা৷
মিয়ানমারের বৌদ্ধ সম্প্রদায়, দেশটির সরকার এবং নেতা অং সান সু চি'র বিরুদ্ধে আন্দোলনও করছে ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানের বিভিন্ন ইসলামি গোষ্ঠী৷ সু চি'র নোবেল পদক বাতিলের দাবি ক্রমেই জোরালো হচ্ছে৷
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটিতে যা ঘটছে, তা সত্যিই নিন্দার দাবি রাখে৷ কিন্তু রোহিঙ্গা সংকটে মুসলিম দেশগুলোর প্রতিক্রিয়াও সমানভাবে নিন্দনীয়৷
ধর্মীয় নিপীড়ন
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলিতে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের যে ইতিহাস, তা ভয়ানক৷ ১০ সেপ্টেম্বর, রোববার পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমের শহর কোয়েটায় তিন হাজার শিয়া মতাবলম্বীকে খুন করা হয়েছে৷ এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে বহু বছর ধরে কিছু ইসলামি গোষ্ঠী লাগাতার নির্যাতন করে এসেছে৷ সরকার কখনোই তাদের হাহাকারে সাড়া দেয়নি৷
দশকের পর দশক ধরে হিন্দু, খ্রিস্টান ও আহমাদিয়া সম্প্রদায়ের লোকদের প্রতি রাষ্ট্রীয় বৈষম্য চলে আসছে৷ ইসলামি দেশ পাকিস্তানের ব্লাসফেমি আইন বিভিন্ন ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে বাধ্য করছে দিনের পর দিন আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাতে৷ আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে খ্রিস্টান অধ্যুষিত এলাকায়, ইসলাম বা নবী মোহাম্মদকে ‘অপমান' করার দায় দিয়ে হত্যা করা হয়েছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের৷
ধর্মভিত্তিক অত্যাচার-নিপীড়ন অন্যান্য মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলিতেও বেড়েই চলেছে৷ ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় ‘পলিটিক্যাল ইসলামের' উত্থান সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে ফেলছে হুমকির মুখে৷ এটা খুবই হাস্যকর বিষয় যে, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ার চরমপন্থি ইসলামি দলগুলো এখন মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতনের প্রতিবাদ করছে৷
বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত জাতিগুলোর মধ্যে একটি রোহিঙ্গা, তা অবশ্য অস্বীকার করার অবকাশ নেই৷ রাষ্ট্রবিহীন এই জাতি দশকের পর দশক ধরে দেশটিতে বাস করলেও তাদের নাগরিক মানতে নারাজ মিয়ানমার সরকার৷ মুসলিম সংখ্যাগুরু প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশও তাদের নিতে চায় না৷ মানবজাতির ইতিহাসে এ এক করুণ ট্র্যাজেডি৷ কিন্তু এই সংকটে ধর্মীয় রং চড়িয়ে, একটি জাতির নিপীড়নের ইতিহাসকেই অস্বীকার করা হচ্ছে৷ এই লড়াই মুসলিম ও বৌদ্ধদের নয়৷
পশ্চিমা বিশ্ব এবং তাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও অধিকার সংস্থা ২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে এ নিয়ে সোচ্চার রয়েছে৷ গত মাসে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে গঠিত কমিশনের প্রধান জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনান মিয়ানমার সরকারের কাছে একটি প্রতিবেদন জমা দেন৷ রোহিঙ্গাদের নাগরিক হওয়ার অধিকার দিতে সু চি সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয় সেই প্রতিবেদনে৷
চিৎকার-চেঁচামেচি করতে থাকা ইসলামী গোষ্ঠী, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শহীদ খাকান আব্বাসির চেয়েও আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো মিয়ানমার এবং বাংলাদেশে অবস্থান করা রোহিঙ্গাদের জন্য অনেক বেশি কাজ করছে৷
জাতিগত দৃষ্টিভঙ্গি
বেছে বেছে প্রতিবাদ করাটা বিভিন্ন ইসলামি গোষ্ঠীর আরো এক ভণ্ডামি৷ সৌদি আরবের মিত্ররা শিয়া অধ্যুষিত ইয়েমেনে রিয়াদের বোমা নিক্ষেপের বিষয়ে বরাবরই নীরব থেকেছে৷ ২০১৫ সাল থেকে হাজার হাজার ইয়েমেনিকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে৷ কিন্তু এ বিষয়ে পাকিস্তান বা উপসাগরীয় দেশগুলোর পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য আসেনি৷
সিরিয়া এবং ইরাক সংকটকেও মুসলিম দেশগুলো ব্যাখ্যা করে সৌদি আরব অথবা ইরানের সাথে ঘনিষ্ঠতার ভিত্তিতে৷ ইসলামি জঙ্গিদের হত্যাকাণ্ড এবং নৃশংসতাকে বেশিরভাগ সময়ই দেখা হয় সাম্প্রদায়িক চশমা চোখে পড়ে৷
সংকটের ইসলামিকীকরণ
২৫ আগস্ট মিয়ানমারের নিরাপত্তাবাহিনীর ওপর হামলা চালানো আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি আরসা'র জিহাদি যোগসাজশ রয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে৷ সৌদি আরব, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের সাথেও রোহিঙ্গা জঙ্গিদের যোগাযোগ থাকার সংবাদ পাওয়া গেছে৷ আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের লড়াইয়ে সাহায্যের নামে তহবিলও সংগ্রহ করছে৷
ইন্দোনেশিয়ার ইসলামি জঙ্গিরাও ধীরে ধীরে এই সংকটের সাথে যুক্ত হচ্ছে৷ এসব ইসলামি গোষ্ঠীর আল কায়েদা এবং আইএসের সাথেও যোগাযোগ রয়েছে৷ মিয়ানমার সরকার বলছে, তারা শুধু এই জিহাদের হুমকি মোকাবেলা করছে৷ রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানের যুক্ত হিসেবে এই তথ্য কাজেও লাগাচ্ছে দেশটির সরকার৷
সংকটের কূটনৈতিক ও মানবিক সমাধানের বদলে উলটো মিয়ানমার সরকারের‘জিহাদি গোষ্ঠী' বক্তব্যকেই সঠিক প্রমাণ করছে মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্রগুলো৷ এই অবস্থান রাষ্ট্রবিহীন রোহিঙ্গাদের শক্তিশালী নয়, বরং দিন দিন আরো দুর্বলই করে তুলবে৷ ইসলামপন্থিদের ভণ্ডামি ও জিহাদি মনোভাব আসছে দিনগুলোকে রোহিঙ্গাদের জন্য বরং আরো কঠিনই করে তুলবে৷
শামিল শামস/এডিকে