1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বাড়ছে সহিংসতা, বাড়ছে উদ্বেগ

সমীর কুমার দে
২৩ অক্টোবর ২০২১

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সাম্প্রতিক সহিংসতা ও অস্ত্রের ব্যবহার আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যার রেশ না কাটতেই খুন হয়েছেন আরো ৬ জন৷ 

https://p.dw.com/p/425zA
Bangladesh I Rohingya Refugee Camp in Cox's Bazar
ছবি: Kazi Salahuddin Razu/NurPhoto/picture alliance

গত ২৯ অগাস্ট কক্সবাজারের উখিয়ায় লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গুলি চালিয়ে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাহকে হত্যা করা হয়৷ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি তারা এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করেছে৷ শনিবার খুনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত একজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ান- এবিপিএন৷ তবে পরিকল্পনাকারী পর্যন্ত এখনও পৌঁছাতে পারেনি পুলিশ৷ তাদের তথ্য অনুযায়ী, এই হত্যা মিশনে অংশ নেয় ১৯ জন৷ এদের মধ্যে পাঁচজন ছিলেন অস্ত্রধারী৷ পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে কয়েক মিনিটেই কিলিং মিশন শেষ করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে খুনিরা৷

১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক এসপি নাইমুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, হত্যায় সরাসরি অংশ নেওয়া আজিজুল হককে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ আজিজুল হক প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন, তিনি কিলিং মিশনে ছিলেন৷ তার সঙ্গে আরও তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ তারা হলেন, কুতুপালং ক্যাম্প-১ এর ডি-৮ ব্লকের আব্দুল মাবুদের ছেলে মোহাম্মদ রশিদ ওরফে মুরশিদ আমিন ও একই ক্যাম্পের বি ব্লকের ফজল হকের ছেলে মোহাম্মদ আনাস ও নুর ইসলামের ছেলে নুর মোহাম্মদ৷

‘মুহিবুল্লার হত্যার দুদিন আগে বৈঠক করে দূর্বৃত্তরা’

মুহিবুল্লাহকে হত্যা যেভাবে

এসপি নাইমুল হক বলেন, ‘‘জিজ্ঞাসাবাদে আজিজুল বলেছেন, মুহিবুল্লার হত্যার দুদিন আগে মরকাজ পাহাড়ে কিলিং মিশনের জন্য বৈঠক করে দূর্বৃত্তরা৷ সেখান থেকে ১৯ জনকে মিশনে অংশ নেওয়ার নির্দেশনা দিয়ে পাঁচজনকে সশস্ত্র অবস্থায় পাঠানো হয়৷ মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গাদের নেতা হিসেবে পরিচিত৷ তার উত্থান ও প্রত্যাবাসন ঠেকাতে যেকোনো মূল্যে তাকে হত্যা করার নির্দেশ দেওয়া হয়৷ সেই নির্দেশনা মতো ২৯ সেপ্টেম্বর মুহিবুল্লাহকে বাসা থেকে অফিসে ডাকা হয়৷ প্রত্যাবাসন বিষয়ে কয়েকজন কথা বলতে ডাকছে বলে বাসা থেকে বের করে আনে গ্রেপ্তার মুরশিদ৷ এরপর বাকিদের সংকেত দিয়ে সে অফিস থেকে চলে যায়৷’’

নাইমুল হক আরও বলেন, ‘‘সশস্ত্র টিম অফিসে ঢুকে একজন মুহিবুল্লাহকে বলে ‘ওঠ' তোর সঙ্গে কথা আছে৷ বসা থেকে উঠতেই প্রথমজনের একটি, তার পরেরজনের দুটিসহ মোট চারটি গুলি করা হয় মুহিবুল্লাহকে৷ এরপর মুহিবুল্লার বাড়ির পেছন দিয়ে পালিয়ে যায় স্কোয়াডের পাঁচজন৷ পরে সবাই সতর্ক হয়ে যায়৷’’ এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১০ জন গ্রেপ্তার হয়েছে৷

বাড়ছে অস্ত্রের ব্যবহার

শুধু মুহিবুল্লাহর হত্যাকাণ্ডই নয়, এর আগেও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে৷ বিভিন্ন সময় সেখান থেকে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে৷ কক্সবাজার জেলা পুলিশের হিসেব অনুযায়ী ২০১৮ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে টেকনাফ ও উখিয়া থানায় অস্ত্র মামলা হয়েছিল ১৩টি৷ পরের বছর তা বেড়ে হয় ১৭টি৷ ২০২০ সালে ২৭টি অস্ত্র মামলা হয়৷ চলতি বছরের নয় মাস ২৩ দিনে ১৫টি অস্ত্র মামলা হয়েছে৷ ওই সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে ১৪টি দেশীয় পিস্তল, ৪৪টি এলজি, তিনটি বিদেশি পিস্তল, ৩০টি একনলা বন্দুক, ২৫টি দেশি বন্দুক, চারটি পাইপগানসহ প্রচুর পরিমাণ ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে৷ সব মিলিয়ে এই সময়ের মধ্যে ১২৩টি অস্ত্র পুলিশ উদ্ধার করেছে৷

সর্বশেষ শুক্রবার ভোর রাত সোয়া ৪টার দিকে উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের ১৮ নম্বর ময়নারঘোনা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গোলাগুলি হয়৷ এই ঘটনায় যে ছয়জন খুন হয়েছেন তারা ১৮ নম্বর ক্যাম্পের মসজিদে ছিলেন৷ পাশেই ১৯ নম্বর ক্যাম্পে বসবাস করেন শাহ আলম৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘মুহিবুল্লাহ হত্যার পর থেকে আমরা আতঙ্কেই ছিলাম৷ এরপর আবার পাশের ক্যাম্পে ৬ জন খুনের পর আমরা আসলে পরিবার নিয়ে শঙ্কার মধ্যেই আছি৷ পুলিশ পাহারা দিচ্ছে, কিন্তু সাধারণ রোহিঙ্গারা খুব আতঙ্কে আছেন৷’’

সন্ত্রাসীদের গুলিতে রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ নিহত

অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ৮৯ রোহিঙ্গা খুন

পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট থেকে চলতি বছরের ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত টেকনাফ ও উখিয়া থানায় ৮৯ জন রোহিঙ্গা খুন হয়েছেন৷ এসব ঘটনায় ৮০টি মামলা হয়েছে৷ এর বাইরে ২৪ জন রোহিঙ্গা বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হন৷ সর্বশেষ শনিবার মারা গেছেন ৬ জন৷

২০১৮ সালের মে মাসে দেশব্যাপী শুরু হওয়া মাদকবিরোধী অভিযানে কক্সবাজারে বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হয়েছেন ২৭৯ জন৷ এদের মধ্যে রোহিঙ্গা ১০৯ জন৷ নিহত রোহিঙ্গাদের মধ্যে তিনজন ছিলেন নারী৷

মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘রোহিঙ্গাদের মধ্যে যেসব তরুণ আছে, তাদের কোন না কোন কাজে লাগাতে হবে৷ তা না হলে এই ধরনের পরিস্থিতি বন্ধ করা যাবে না৷ দেখেন তরুণরা সারাদিন ঘরে বসে থাকে৷ কী করবে তারা? কোন না কোন সন্ত্রাসী গ্রুপ তাদের কাজে লাগাতে চাইবে? একসময় হয়ত তারা এসব গ্রুপে যোগ দিয়ে ফেলবে৷ পাশাপাশি ক্যাম্পে যে গ্রুপগুলো আছে তাদেরও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে৷’’

রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ১,৩৬৮টি মামলা

কক্সবাজারের ৩৪টি রোহিঙ্গা শিবিরের মধ্যে টেকনাফ থানা এলাকায় ১১টি ও উখিয়া থানা এলাকায় ২৩টি শিবিরের অবস্থান৷ ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত চার বছরে এ দু'টি থানায় রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এক হাজার ৩৬৮টি মামলা হয়েছে৷ এগুলোতে আসামি করা হয় ২ হাজার ৩৭৮ জনকে৷ যাদের মধ্যে এক হাজার ৭৫৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ৷ পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, মূলত ১০ ধরনের অপরাধে এসব মামলা হয়েছে৷ এগুলো হচ্ছে- অস্ত্র, মাদক, ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ, অবৈধ অনুপ্রবেশ, অপহরণ, পুলিশের উপর হামলা, ডাকাতি ও ডাকাতির প্রস্তুতি, হত্যা এবং মানবপাচার৷ এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয়েছে মাদক মামলা ৭০৬টি৷ ২০১৭ সালের পর থেকে ক্যাম্পগুলোতে মাদক অপরাধ বেড়েই চলেছে৷

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এত অল্প জায়গায় ১১-১২ লাখ রোহিঙ্গা থাকে৷ তাদের কোন কাজ নেই৷ ফলে তারা অপরাধ প্রবণ হয়ে উঠাই স্বাভাবিক৷ বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই ধরনের অপরাধ প্রবণ হয়ে উঠার সম্ভাবনা বেশি৷ এখানে আমাদের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য দু'টি চ্যালেঞ্জ৷ একটি হল, এদের নিরাপত্তা দেওয়া৷ খুনোখুনির ঘটনা বাড়তে থাকলে আন্তর্জাতিক মহল থেকে বলা হবে, আমরা তাদের নিরাপত্তা দিচ্ছি না, শৈথিল্য দেখাচ্ছি৷ আরেকটা চ্যালেঞ্জ হল, এতগুলো মানুষকে মনিটর করা খুব কঠিন৷ এত ছোট ছোট ঘর, সেখানে কী হচ্ছে, তা ঘরে ঘরে গিয়ে মনিটর করা সম্ভব না৷ তারপরও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছে৷ কিছু ফোর্স এখন বাড়াতে হবে৷’’

‘তাদের কোন কাজ নেই, ফলে তারা অপরাধ প্রবণ হয়ে উঠাই স্বাভাবিক’

সীমান্ত পেরিয়ে আসে অস্ত্র, আছে দেশীয় অস্ত্রের কারখানাও

আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির মধ্যেও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কী করে অস্ত্র আসছে সেটি বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিচ্ছে৷ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি, ভারত ও মিয়ানমারের অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে আসা অস্ত্র যাচ্ছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের কাছে৷ তবে এসব অস্ত্রের প্রধান উৎস মিয়ানমার৷ রোহিঙ্গাদের মধ্যে অস্ত্রের বিস্তার নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল কয়েকদিন আগে বলেছেন, মিয়ানমার থেকে বিভিন্নভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পরিবেশ অস্থির করার জন্য এখানে অস্ত্র আসছে৷ অস্ত্র নিয়ে তাদের আধিপত্য বিস্তার করার জন্য বিভিন্ন গ্রুপ মারামারি করছে৷

এছাড়া কিছু স্থানীয় দুর্বৃত্তের সহায়তা নিয়েও পাহাড়ি এলাকায় অবৈধ অস্ত্রের কারখানা বানিয়ে তারা সংগ্রহ করছে নানা ধরনের দেশীয় অস্ত্র৷ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সরবরাহের জন্য গহীন পাহাড়ে গড়ে তোলা হয়েছে অস্ত্র তৈরির অস্থায়ী কারখানাও৷ সেখানে চারপাশে পাহারা বসিয়ে লেদ মেশিন ও অন্যান্য যন্ত্রাংশের সহায়তায় দেশীয় প্রযুক্তিতে আগ্নেয়াস্ত্রসহ নানা ধরনের দেশীয় অস্ত্র তৈরি করা হয়৷ গত বছরের ৫ অক্টোবর এমন একটি অস্ত্র তৈরির কারখানা শনাক্ত করেছিল র‌্যাব৷ সেখান থেকে অস্ত্র তৈরির দুই কারিগরকে আটক করা হয়৷ পরে তাদের স্বীকারোক্তি মতে ৩টি দেশি অস্ত্র, ২ রাউন্ড গুলি ও অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়৷ আটক দু'জনই বাংলাদেশি নাগরিক৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান