লকডাউনে কর্মহীন প্রায় ১২ কোটি
১৪ এপ্রিল ২০২০প্রথমবার লকডাউন ঘোষণার সময়েও তিনি বলেছিলেন, মঙ্গলবার ৩ মে পর্যন্ত লকডাউন বৃদ্ধির নির্দেশ দেওয়ার সময়ে ফের দেশের প্রধানমন্ত্রী বললেন, সংকট কালে কারও চাকরি যেন চলে না যায়। চাকরিদাতাদের এ দায়িত্ব পালন করতে হবে। কিন্তু বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ অন্যরকম। পরিসংখ্যান বলছে, গত এক মাসে প্রায় ১২ কোটি ভারতীয় চাকরি হারিয়েছেন বা চাকরি হারানোর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন। পরিস্থিতি এ ভাবেই চলতে থাকলে আরও চাকরি যাওয়ার আশঙ্কা।
সম্প্রতি দেশের চাকরির বাজার নিয়ে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল সেন্টার ফর দ্য মনিটারিং অফ ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই) নামের একটি স্বাধীন সংস্থা। প্রতি বছরেই তারা এই সমীক্ষা চালায়। ৫ এপ্রিল পর্যন্ত সমীক্ষা চালিয়ে যে রিপোর্ট তারা পেশ করেছে, তা ভয়াবহ। রিপোর্টে বলা হয়েছে, মাত্র দুই সপ্তাহে ভারতে চাকরি হারানোর হার ২৩ দশমিক ৪ শতাংশ। অদূর ভবিষ্যতে যা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। অর্থনীতিবিদদের মতে, কোনও দেশে যখন বেকারত্বের হার ২০ শতাংশের উপরে চলে যায়, তখন অর্থনৈতিক মন্দা স্পষ্ট হয়। ফলে গত দুই সপ্তাহের হিসেবে স্পষ্ট, ভারতে তীব্র অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হতে চলেছে।
এই মুহূর্তে ভারতের জনসংখ্যা ১৩৭ কোটি। এর মধ্যে ১৫ বছরের উপরে কর্মক্ষম ব্যক্তির সংখ্যা ১০৪ কোটি। রিপোর্ট বলছে, সাধারণত, ১৫ থেকে ৬০-- এই বয়সসীমাকেই কর্মক্ষম প্রজন্ম হিসেবে ধরা হয়। সিএমআইই-র হিসেব অনুযায়ী এর মধ্যে গত এক বছরে লাগাতার কাজ করেছেন এবং উপার্জন করেছেন প্রায় ৪০ কোটি লোক। এর বাইরে কৃষিক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত বহু মানুষ। রিপোর্ট বলছে, ওই ৪০ কোটির মধ্যে গত দুই সপ্তাহে কাজ হারিয়েছেন বা হারানোর পরিস্থিতিতে পৌঁছেছেন প্রায় ১২ কোটি লোক। যার মধ্যে প্রায় ৮ কোটি ব্যক্তি পরিবারের একমাত্র বা প্রধান রোজগেরে। আগামী দিনে এই সংখ্যাটা আরও বাড়তে পারে বলেই আশঙ্কা।
ভারতীয় অর্থনীতির বিশ্লেষক এবং ইনকিউবের ডিরেক্টর ত্রিদিবেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ''গত কয়েক বছর ধরেই ভারতীয় অর্থনীতির পতন শুরু হয়েছিল। আমাদের ধারণা ছিল ২০২০ সালের শেষ পর্বে পৌঁছে চার থেকে পাঁচ কোটি লোক কাজ হারাবেন। কিন্তু করোনার কারণে সেই সংখ্যাটা রাতারাতি দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে গিয়েছে। এখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন। অর্থনীতির কাঠামোই বদলে যেতে শুরু করেছে।''
অর্থনীতিবিদ এবং ভারত সরকারের প্রাক্তন মুখ্য সংখ্যাতত্ত্ববিদ প্রণব সেন জানিয়েছেন, ''অন্তত পাঁচ কোটি লোক অর্থনৈতিক ভাবে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। করোনা পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেলেও অর্থনীতির এই দৈন্যদশা থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। বহু দিন লেগে যাবে এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে।''
দেশের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রকের সচিব এবং বিশ্ব ব্যাঙ্কের প্রাক্তন আধিকারিক সুভাষ চন্দ্র গর্গের বক্তব্য, ''করোনার জন্য দেশের অর্থনীতির ৭০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাজস্ব আদায় মার খেয়েছে, অভূতপূর্ব পরিকল্পনা ছাড়া এই পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন''।
ডয়চে ভেলেকে ত্রিদিবেশ জানিয়েছেন, দুই দিক থেকে বর্তমান সংকটকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। এক, দেশের ভিতরে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে মানুষ কাজ হারাচ্ছেন। সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পরিষেবা ইন্ডাস্ট্রি। হোটেল, বিমান, পর্যটন শিল্প কার্যত ভেঙে পড়েছে। অন্য দিকে অসংগঠিত ক্ষেত্রেও এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। নির্মাণ শিল্প, কারখানার সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকেরা রাতারাতি কাজ হারিয়েছেন। যাঁদের পরিযায়ী শ্রমিক বলা হচ্ছে। ত্রিদিবেশের ধারণা, ''এঁদের অনেকেই আর শিল্পক্ষেত্রে ফিরবেন না। নিজ নিজ গ্রামে কৃষির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবেন। কারণ, এত মন্দা সত্ত্বেও কৃষিক্ষেত্রে এখনও তার প্রভাব সে ভাবে দেখা যাচ্ছে না। নিজের বাড়িতে থেকে কৃষিক্ষেত্রে কাজ করলে অন্তত প্রতিদিনের খাবার তাঁদের জুটে যাবে।'' বিশ্লেষণের দ্বিতীয় পর্যায়ে চলে আসে বিশ্ব মন্দার প্রসঙ্গ। দেশের অর্থনীতির একটি বড় অংশ তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর। কারণ, ইউরোপ এবং অ্যামেরিকার বড় বড় সংস্থাগুলি কম দামে ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীদের নিয়োগ করে। বিশ্ব অর্থনীতির সার্বিক পতনের কারণে সেই কর্মীরাও এখন সমস্যায়। বহু বিপিও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। চাকরি চলে গিয়েছে অনেকের। অ্যামেরিকায় কর্মরত তথ্য প্রযুক্তি কর্মীদের অনেককেই দেশে ফিরে যেতে বলেছে তাঁদের সংস্থাগুলি।
এই মুহূর্তে ভারতের পরিষেবা ক্ষেত্র, তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্র এবং উৎপাদন শিল্প সব চেয়ে সমস্যার মুখে। এই সমস্ত ক্ষেত্রেই সব চেয়ে বেশি কর্মী ছাঁটাই হচ্ছেন। একই সঙ্গে মার খাচ্ছে সংবাদসংস্থাগুলি। কারণ দেশের অধিকাংশ সংবাদ সংস্থাই বিজ্ঞাপন নির্ভর। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিজ্ঞাপন আসছে না। অন্য দিকে নিউজ প্রিন্টের দাম খুব বেড়ে গিয়েছে। ফলে বহু সংস্থা সংবাদপত্রের বহর ছোট করে ফেলছে। ছাঁটাই করা হচ্ছে কর্মীদের। মঙ্গলবারই এ বিষয়ে সরকারের হস্তক্ষেপ দাবি করেছে ভারতীয় নিউজ পেপার সোসাইটি।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের বক্তব্য, লকডাউনের ফলে অর্থনীতির যে এই অবস্থা হবে, সরকারের তা অজানা ছিল না। ফলে লকডাউন ঘোষণা করার সময় বিপুল পরিমাণ কর্মীর জীবিকার কথা সরকারের ভাবা উচিত ছিল। করোনা থেকে বাঁচাতে গিয়ে দেশের একটা বড় অংশের মানুষকে কার্যত অনাহারের দিকে ঠেলে দেওয়া হলো। মুখে চাকরি রক্ষার কথা বললেও বাস্তবে এ বিষয়ে সরকার কার্যত নির্বিকার। দ্রুত ব্যবস্থা নিতে না পারলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে। বস্তুত, পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৩২-'৩৩ সালে অ্যামেরিকায় গ্রেট ডিপ্রেশন বা মহামন্দার সময়ে কাজ হারিয়েছিলেন দেড় কোটি মানুষ। পৃথিবীর ইতিহাসে সেটাই এক সঙ্গে সব চেয়ে বেশি কাজ হারানোর ঘটনা। ভারত এর মধ্যেই সেই ইতিহাস টপকে গিয়েছে।