মোদীর গিমিক, হাতে রইল মোমবাতি
৩ এপ্রিল ২০২০পশ্চিমবঙ্গে একটা প্রবাদ বহুল প্রচলিত-- 'হাতে হ্যারিকেন'। অর্থাৎ, ভবিষ্যৎ পুরোপুরি অন্ধকার।
শুক্রবার সকালে ১৩০ কোটি ভারতবাসীকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যা বললেন, তাতে সে কথাই মনে হচ্ছে। দেশবাসীর ভবিষ্যৎ অন্ধকার। সোশ্যাল মিডিয়ায় চলছে উপহাস। এই ভয়াবহ করোনা-কালে জাতির উদ্দেশে ভাষণে নরেন্দ্র মোদী বিধান দিলেন, রোববার রাত নয়টায় ঘরের আলো নিভিয়ে মোমবাতি, প্রদীপ অথবা মোবাইলের টর্চ জ্বালতে হবে নয় মিনিটের জন্য। এটাই নাকি এই মুহূর্তে করোনার সঙ্গে যুদ্ধে সব চেয়ে জরুরি করণীয়। যা শুনে অনেকেই বলছেন, মোদী বুঝে গিয়েছেন দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তাই কার্যত দেশবাসীর হাতে হ্যারিকেন ধরিয়ে দিলেন।
অন্ধকার তো বটেই। শুধু ভারতের নয়, করোনার বেপরোয়া আক্রমণে কার্যত গোটা পৃথিবীর অবস্থাই ভয়াবহ। পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ লকডাউনের কবলে। ১০ লক্ষ মানুষ ভাইরাসে আক্রান্ত। এখনও পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৫০ হাজারেরও বেশি। প্রতিদিন আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা লাফিয়ে বাড়ছে। বিশ্ব অর্থনীতি নিম্নগামী। এর মধ্যেই কাজ হারিয়েছেন কয়েক লাখ মানুষ। পরিস্থিতি এমনই চলতে থাকলে ধনে-প্রাণে শেষ হয়ে যাবেন আরও কয়েক লাখ। এই পরিস্থিতিতে কি বলছেন বিশ্ব নেতারা? ডনাল্ড ট্রাম্পের মতো কিছু নেতাকে বাদ দিলে অধিকাংশই দেশের মানুষ, বিশ্বের মানুষকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন। বলছেন, পরিস্থিতি সঙ্কটজনক সন্দেহ নেই, কিন্তু ঘুরে দাঁড়াতে হবে। আর সেই ঘুরে দাঁড়ানোয় সরকার মদত দেবে।
পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে, তাতে সব ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষেও মদত দেওয়া কঠিন। কারণ বিশ্ব জুড়ে উৎপাদন শিল্প কার্যত বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বন্ধ যোগাযোগ ব্যবস্থা। তেলের দাম কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকেছে। মুদ্রাস্ফীতি ভয়াবহ চেহারা নিয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতি যে গভীর মন্দায় ডুবে যেতে শুরু করেছে, তারও ইঙ্গিত দিয়ে দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ বলছেন, এই জটিল পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে হবে। যাকে বলে প্যারাডাইম শিফট। তথাপি চেষ্টা করছেন বিশ্ব নেতারা। জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল দেশের মানুষের জন্য অর্থনৈতিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। কানাডার রাষ্ট্রপ্রধান জাস্টিন ট্রুডো দেশবাসীকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন, এই মন্দার সময়ে সাধারণ মানুষকে সব রকম ভাবে সাহায্য করবে দেশের সরকার। ইউরোপের বহু দেশে কাজ হারানো মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে স্থানীয় বা জাতীয় সরকার। তাঁরা সাধারণ মানুষকে আলোর দিশা দিচ্ছেন।
তাকানো যাক ভারতের দিকে। ইউরোপ বা অ্যামেরিকার সঙ্গে এ দেশের পরিস্থিতি মেলে না। কারণ, ভারত উন্নয়নশীল দেশ। এ দেশের সিংহ ভাগ মানুষ দরিদ্র। দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করেন বহু লোক। অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন দেশের অর্ধেকরও বেশি। তাঁদের একটা বড় অংশই দিন আনি দিন খাই শ্রমিক। দিন ভিত্তিক কাজের নিরিখে যাঁরা সামান্য অর্থ রোজগার করেন। এক সপ্তাহ কাজ না থাকলে তাঁদের ঠিক কী অবস্থা হয়, ভারত সে ছবি এর মধ্যেই দেখে ফেলেছে। লকডাউনের আবহে দেশ জুড়ে হাজার হাজার শ্রমিকের ভুখা মিছিল এখনও টাটকা স্মৃতি। করোনায় নয়, স্রেফ না খেতে পেয়ে, সামান্য জলটুকুও না পেয়ে দেশের রাজপথে মৃত্যু হয়েছে তাঁদের। এখনও হচ্ছে। মধ্যবিত্তের অবস্থাও তথৈবচ। লকডাউনে ঘরে বসে বসেই কাজ হারানোর নোটিস পাচ্ছেন বহু মানুষ। খবর আসছে, কোম্পানি বেতন কমিয়ে দিচ্ছে। শুধু বেসরকারি সংস্থা নয়, দেশের বহু রাজ্যে সরকারি কর্মীদেরও বেতন কমানো হয়েছে।
এ তো গেল চেনা কাজের পরিসর। এর বাইরেও অসংখ্য মানুষ আছেন। লোকের বাড়ি ঠিকে কাজ করে, আবাসনে পাহারাদারের কাজ করে, সকালে খবরের কাগজ বিলি করে, রাস্তার ধারে রোল-তেলে ভাজার দোকান চালিয়ে, পাড়ায় পাড়ায় রিক্সা চালিয়ে যাঁরা দিন গুজরান করেন, অসংগঠতি ক্ষেত্রের তালিকাভুক্ত শ্রমিকদের মধ্যেও তাঁরা পড়েন না। লকডাউনের আবহে তাঁদের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। আরও যন্ত্রণাদায়ক।
আর করোনা পরিস্থিতি? এত লকডাউন, এত কাণ্ডের পরেও দেশে প্রতিদিন করোনার সংক্রমণ বাড়ছে। অভিযোগ উঠছে, যথেষ্ট পরিমাণ পরীক্ষা হচ্ছে না। কিছু দিন আগেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছিল, ভারতে প্রতি ১০ লাখে মাত্র তিন জনের করোনা পরীক্ষা হচ্ছে। অভিযোগ উঠছে, শহরে তা-ও কিছু পরীক্ষা হচ্ছে, চিকিৎসা হচ্ছে, গ্রামাঞ্চলে কিছুই হচ্ছে না। শহরের হাসপাতাল গুলির পরিকাঠামো নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন খোদ চিকিৎসকরা। করোনা আতঙ্ক এতটাই ছড়িয়েছে যে বিভিন্ন জায়গায় স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে গিয়ে মার খাচ্ছেন চিকিৎসকরা। এখনও পর্যন্ত এ সব কোনও বিষয়েই একটি কথাও বলেনি সরকার।
দিন কয়েক আগে হঠাৎ লকডাউন ঘোষণার জন্য ক্ষমা চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। বলেছিলেন, সাধারণ মানুষের এই দুর্ভোগের জন্য তিনি ব্যথিত। বস্তুত, ভারত সরকারও আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। কিন্তু সত্যিই কি তা যথেষ্ট? প্রতিদিন যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে ১৩০ কোটি মানুষকে যেতে হচ্ছে, তার নিরিখে ওই প্যাকেজ নেহাতই অপ্রতুল। না, কেবল বিশেষজ্ঞরা নন, সরকারি দলেরও অনেকে সে কথা এক কথায় স্বীকার করে নিচ্ছেন। সকলেই বুঝতে পারছেন, সকলের কাছে সাহায্য তো দূরের কথা, আশ্বাসটুকুও পৌঁছে দেওয়া যায়নি।
করোনার সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য লকডাউনের প্রয়োজন ছিল, এ কথা অনেকেই মানছেন। এমনকী, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও শুক্রবার বলেছে, সময়ের আগেই লকডাউন করে ভারত বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে। দেশের মানুষ আশা করেছিলেন, শুক্রবার সকালে প্রধানমন্ত্রী আরও একটু বিচক্ষণতার প্রমাণ দেবেন। পৃথিবীর আরও অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের মতো তিনিও গরিব মানুষের উদ্দেশে কিছু আশার কথা শোনাবেন। বলবেন, সরকার পাশে আছে।
আশ্বাস তো দূরের কথা, মোদী যা বললেন, তা এক কথায় গিমিক ছাড়া আর কিছু নয়। গোটা দেশকে টেলিভিশন সেটের সামনে বসিয়ে এই'হাস্যকৌতূকে'র অর্থ কী, তা অনেকেই বুঝে উঠতে পারছেন না। তবে এই প্রথম নয়, এর আগেও এমন নানা কথা প্রধানমন্ত্রী মহোদয় বলেছেন। ২১ মার্চ দেশবাসীকে 'জনতা কার্ফু' করতে বলে মোদী বলেছিলেন, বিকেলে থালা-বাসন-কাঁসর-ঘণ্টা বাজাতে। আর কিছু না পেলে হাততালি দিতে। যুক্তিও সাজিয়েছিলেন। বলেছিলেন, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমকে অভিবাদন জানাতেই এই উদ্যোগ। বস্তুত, পৃথিবী জুড়ে সাধারণ মানুষ এ ভাবেই তাঁদের অভিবাদন জানাচ্ছেন। কোথাও কোথাও গান গেয়ে তাঁদের কুর্নিশ জানানো হচ্ছে। কিন্তু সেই সব কিছুই মানুষ করছেন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে। সরকারকে বলে দিতে হচ্ছে না। আবার এও সত্য, কোথাও কোথাও থালা বাসন বাজিয়ে সরকারের অকর্মন্যতার প্রতিবাদও জানানো হচ্ছে। ব্রাজিল তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। মোদীর এ দিনের ঘোষণা শুনে অনেকেই বলছেন, আর কিছু দিন পরে সরকারের বিরুদ্ধেই না মানুষ মোদীর উচ্চারিত অস্ত্রগুলি ব্যবহার করতে শুরু করেন।
তাঁর কথা যে ঠাট্টার খোরাক হতে পারে, মোদী নিজেও তা ভালোই বোঝেন। তবু কেন তিনি এ সব কথা বলছেন? দু'টি বিষয় এ ক্ষেত্রে মাথায় রাখলে ভালো। এক, দেশে এখনও অন্ধ মোদী ভক্তের সংখ্যা নেহাত কম নয়। মোদীর কথা কতটা প্রাসঙ্গিক এবং বৈজ্ঞানিক তা প্রমাণ করতে নেট দুনিয়ায় নেমে পড়েছে গেরুয়া বাহিনীর তথ্যপ্রযুক্তি সেল। এমনও কথা বলা হচ্ছে, নয় মিনিট মোমবাতি জ্বালালে আবহাওয়া মণ্ডলে তাপমাত্রা নয় ডিগ্রি বেড়ে যাবে। আর তাতেই করোনা ভাইরাস মরে যাবে। দেশের অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত জনগণ এ সব বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন। তাঁরা ভাবতে শুরু করেছেন, সত্যিই হয়তো এ ভাবে ভাইরাস মেরে ফেলা সম্ভব। ঠিক কয়েক সপ্তাহ আগে তাঁরাই তো ভেবেছিলেন থালা-বাসন বাজিয়ে ভাইরাস তাড়ানো সম্ভব! চিকিৎসকদের জন্য তাঁরা হাততালি দেননি, মোদীর কথা পালন করে ভাইরাস তাড়ানোর জন্যই তাঁরা কার্ফু ভঙ্গ করে হাতে থালা নিয়ে মিছিল করেছিলেন। এটাই ভারতবর্ষ। আর এই দেশটাকে সত্যিই খুব ভালো চেনেন রাজনীতিবিদরা। তাঁরা জানেন, প্রবল অর্থনৈতিক সঙ্কট, বিপুল অনাহার, ভয়াবহ স্বাস্থ্য বিভ্রাট থেকে কী ভাবে মানুষের চোখ ঘুরিয়ে দিতে হয়।
নরেন্দ্র মোদী শুক্রবার সকালে ঠিক সে কাজটাই করলেন। মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত এবং গরিব মানুষের চোখ ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। গত কয়েক দিন ধরে যে বিষয়গুলি নিয়ে তাঁরা কথা বলছিলেন, যে সমস্যার কথা গুলি তাঁরা তুলে ধরার চেষ্টা করছিলেন, এক ঝটকায় সেই সব কিছুর বাইরে একটা নতুন আলোচনার বিষয় তৈরি করে দিলেন। এটাই রাজনীতি।