1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

লাদাখ বিতর্ক: জিতল কে?

স্যমন্তক ঘোষ নতুন দিল্লি
৭ জুলাই ২০২০

লাদাখ বিতর্ক সমাধানের রাস্তা খুলেছে। দুই পক্ষই উত্তেজনা কমানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এগিয়ে থাকল কে?

https://p.dw.com/p/3etgp
ছবি: Getty Images/AFP/T. Mustafa

লাদাখ সীমান্তে ভারত এবং চীন দুই পক্ষই সেনা সরাতে সম্মত হয়েছে। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে দুই পক্ষই সেনা সরানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, তা হলে কি স্থায়ী সমাধান সূত্র মিলল? উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সাময়িক জয় কার হলো, কেই বা পিছু হটতে বাধ্য হলো?

সমস্যার উৎস

মে মাসের শেষ পর্ব থেকে ভারত এবং চীনের সংঘাতের সূত্রপাত। প্রথমে সিকিমের নাকু লা (লা শব্দের অর্থ পাস) অঞ্চলে হাতাহাতি হয়েছিল ভারত এবং চীনের সেনার। এর এক সপ্তাহের মধ্যেই লাদাখ সীমান্তে ফের হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ে দুই দেশের সেনা। পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল যে ৬ জুন দুই দেশের কোর কম্যান্ডার স্তরের সেনা অফিসাররা বৈঠকে বসেন। ভারত এবং চীনের সেনা অফিসাররা বছরে কয়েকবার ফ্ল্যাগ মিটিং করেন। কিন্তু সেই বৈঠক হয় স্থানীয় অফিসারদের স্তরে। কোর কম্যান্ডার স্তরের বৈঠক বহু দিনের মধ্যে হয়নি। ফলে বোঝাই যায়, পরিস্থিতি কতটা উত্তপ্ত হয়েছিল।

সেনা সূত্রের বক্তব্য, এই ধরনের বৈঠকে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় না। দুই দেশই নিজেদের বক্তব্য একে অপরকে জানিয়ে দেয়। এবং নিজেদের দাবি নিয়ে আলোচনা হয়। সেই বৈঠকের বিষয়বস্তু কূটনৈতিক স্তরে পৌঁছলে দুই দেশ নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছয়। গত ৬ জুন লাদাখের চুসুল সীমান্তে কোর কম্যান্ডাররা তেমনই এক বৈঠক করেন এবং ঠিক হয়, উত্তেজনা কমানোর জন্য দুই দেশ নিয়ন্ত্রণ রেখা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করবে। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি। সে কারণেই ১৫ জুন রাতে গালওয়ানের ১৪ নম্বর পেট্রল পয়েন্টে সংঘর্ষ হয় দুই দেশের সেনার। মৃত্যু হয় ২০ জন ভারতীয় সেনার। চীনের দিকের হতাহতের সংখ্যা এখনও পর্যন্ত স্পষ্ট করেনি পিপলস লিবারেশন আর্মি।

লাদাখে ব্যস্ত যুদ্ধবিমান

শুধু গালওয়ান নয়

সমস্যা কেবল গালওয়ান নিয়ে নয়। পূর্ব লাদাখের প্যাংগং লেক, গোগরা হট স্প্রিং এবং ডেপসং অঞ্চলে ভারত এবং চীনের সীমান্ত নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। প্রশ্ন হলো, কেন এই বিতর্ক? লাদাখের যে অঞ্চলে এই সমস্যা তা মানুষের বসবাসের অযোগ্য। অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে সীমান্ত নির্ধারিত হয় নদী, উপত্যকা কিংবা কাঁটাতার দিয়ে। লাদাখে ভারত এবং চীনের মধ্যে যে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা তার কোনও নির্দিষ্ট চিহ্ন নেই। শীতল মরুভূমিতে কোনও বিশেষ জায়গাকে চিহ্নিত করে সীমান্ত নির্ধারণ করা যায় না। পুরোটাই বালি এবং পাথর। ফলে সীমান্তের একটি কাল্পনিক লাইন তৈরি করে নেওয়া হয়। মাঝের একটি জায়গাকে বাফার জোন হিসেবে ধরা হয়। সেখানে দুই দেশের সেনাই টহল দেয় বা পেট্রোলিংয়ে যায়। সমস্যার সূত্রপাত সেখান থেকেই। ভারতের অভিযোগ চীনের সেনা ওই বাফার জোনকেও নিজেদের এলাকা বলে চিহ্নিত করছে। একই অভিযোগ চীনেরও। তা নিয়েই মে মাসের শেষ থেকে উত্তেজনা চলছিল।

১৫ জুন পরবর্তী কূটনীতি

১৫ জুন রাতের ঘটনার পরে ফের চুসুলে দুই দেশের কোর কম্যান্ডার স্তরের বৈঠক হয়েছে। প্রায় ১১ ঘণ্টা ধরে সেই বৈঠক চলে। তার কয়েক দিনের মধ্যেই ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের সঙ্গে চীনের বিদেশমন্ত্রী তথা স্পেশাল রিপ্রেসেনটেটিভ ওয়াং ই-র ২ ঘণ্টার বৈঠক হয়। তার আগে বিদেশমন্ত্রী হিসেবে ওয়াং ই-র সঙ্গে ভারতের বিদেশমন্ত্রী জয়শংকরেরও বৈঠক হয়েছিল। কিন্তু তাতে কোনও সমাধান সূত্র মেলেনি। অজিত ডোভালের সঙ্গে স্পেশাল রিপ্রেসেনটেটিভ হিসেবে বৈঠক করেছেন ওয়াং ই। তার পরেই ৬ জুলাই ভারত এবং চীন দুইটি বিবৃতি প্রকাশ করে। সেনা সরানোর কথা সেখানে বলা হয়নি। তবে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা যে কমা প্রয়োজন তা উল্লেখ করেছে দুই দেশই।

গালওয়ানের মালিকানা কার?

দুই দেশের বিবৃতি

ভারতের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার কথা মাথায় রেখে স্টেটাস কো মেনে চলতে হবে। এর অর্থ হলো, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা এবং বাফার জোন থেকে অন্তত এক কিলোমিটার দূরে সেনা সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কাঠামোও ভেঙে ফেলতে হবে। একই সঙ্গে ভারতের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দুই দেশের মধ্যে সুম্পর্ক বজায় রাখার জন্য সীমান্তে উত্তেজনা কমানো জরুরি।

চীনের বিবৃতিতেও উত্তেজনা প্রশমনের কথা বলা হয়েছে। তবে চীন বলেছে, দেশের সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে সীমান্তে উত্তাপ কমানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

সূত্র জানাচ্ছে, দুই দেশই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা এবং বাফার জোন থেকে আটশো থেকে দেড় কিলোমিটারের মধ্যে সৈন্য পিছিয়ে নিতে শুরু করেছে। পরবর্তী কম্যান্ডার স্তরের বৈঠকে এর পরের পদক্ষেপ স্থির হবে। কী সেই পদক্ষেপ? 

কূটনৈতিক জয়

এটাই সব চেয়ে বড় প্রশ্ন। ভারতের দাবি গালওয়ান অঞ্চলে বাফার জোনে চীন কাঠামো তৈরি করেছিল। উপগ্রহ চিত্রেও তা ধরা পড়েছে। আপাতত সেই কাঠামো চীন সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু প্যাংগং, গোগরা হট স্প্রিং কিংবা ডেপসংয়ে কী হবে? উদাহরণ স্বরূপ প্যাংগংয়ের কথাই ধরা যাক। ভারতের দাবি, প্যাংগংয়ের ফিঙ্গার পয়েন্ট আট পর্যন্ত ভারতের। চীনের দাবি ফিঙ্গার পয়েন্ট চার পর্যন্ত তাদের। সূত্র জানাচ্ছে, ফিঙ্গার পয়েন্ট চার থেকে চীন সৈন্য সামান্য পিছিয়ে নিয়েছে। কিন্তু পাঁচ থেকে আট পর্যন্ত অঞ্চল যদি চীনকে ছেড়ে দিতে হয়, তা হলে একাধিক কাঠামো ভাঙতে হবে। ডেপসংয়ের ক্ষেত্রেও বিষয়টি অনেকটা একইরকম। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চীন কি তা করবে? যদি করে, তা হলে তা ভারতের বড় কূটনৈতিক জয় হবে।

কিন্তু বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, চীনের বিবৃতিতে যে ইঙ্গিত রয়েছে, তাতে তারা তা করবে বলে মনে হচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে বাস্তব প্রেক্ষাপটে এটাকে আপাতত চীনের কূটনৈতিক জয় বলেই ধরতে হবে বলে মনে করছেন অনেকে। তাঁদের বক্তব্য, কেবল গালওয়ান ধরে লাদাখ সংকট দেখলে ভুল হবে। আলোচনায় রাখতে হবে সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার সীমান্তের গোটাটাই। অরুণাচল বিতর্কে ভারত যেমন কূটনৈতিক ভাবে এগিয়ে আছে, লাদাখের বর্তমান পরিস্থিতিতে চীনও তেমন খানিকটা এগিয়ে থাকলো বলে বিশেষজ্ঞদের একাংশের ধারণা।

তবে পুরোটাই নির্ভর করছে, দুই দেশ ফিঙ্গার পয়েন্টগুলি থেকে এবং ডেপসং থেকে সেনা কতটা সরায় তার ওপর। চীনের সেনা সরে গেলে ভারতের জয় হবে। তা না করলে চীন এগিয়ে থাকবে। একই সঙ্গে আরও একটি কথা বলা দরকার। ভারত-চীনের সীমান্ত সমস্যা এক দিনের নয়। ৬ জুনের বৈঠকে শান্তি প্রস্তাবের পরেও রক্তপাত হয়েছিল। সংঘাত চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছয়। ফলে উত্তাপ কমে গিয়েছে, এমনটা এখনই বলা যাবে না। আর যে রফাসূত্র বেরিয়েছে, তা স্থায়ী নাও হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি স্যমন্তক ঘোষ
স্যমন্তক ঘোষ ডয়চে ভেলে, দিল্লি ব্যুরো