শততম টেস্ট কি শুধুই সংখ্যা?
১৫ মার্চ ২০১৭আবার অন্য এক হিসাবে অবাক হয়েই ভাবতে হয়, ১০০টি টেস্ট খেলতে ১৭ বছর লাগল! গড়ে প্রতিবছর ছয়টিরও কম টেস্ট৷ ১৭ বছর পরও যে টেস্টে মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমাদের শৈশবই কাটেনি, তার কারণও মিলে যায় এই তথ্যে৷ বছরে গড়ে মাত্র ছয়টি টেস্ট খেললে, ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টির হাওয়ায় মজে গিয়ে টেস্টকে দূরে সরিয়ে রাখলে যা হওয়ার তা-ই তো হচ্ছে!
আবার অতীতে ফিরি৷ ২০০০ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস যখন দেওয়া হয়, তখন বাংলাদেশ যোগ্য কিনা, সেই প্রশ্ন উঠেছিল৷ যৌক্তিক প্রশ্ন, সত্যি বললে তখনকার পারফরম্যান্সে বাংলাদেশের চেয়ে কেনিয়াই এগিয়ে ছিল অনেকের কাছে৷ তবু তাদের টপকে যে বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পেল, সেটা এক অর্থে বাংলাদেশের প্রতি পক্ষপাতিত্ব৷ কারো কারো কাছে দীর্ঘদিনের শিষ্য আশরাফুল হককে জগমোহন ডালমিয়ার উপহার৷ কথাটায় কিছু সত্যতা আছে, কিন্তু ডালমিয়া বা ক্রিকেট দুনিয়ার কাছে সেটা বাংলাদেশপ্রীতি ছিল না৷ ছিল নিজেদের স্বার্থ৷ নতুন ধরনের বাণিজ্যিক হাওয়া তৈরি হয়েছে টেলিভিশন সূত্রে, এখন এই টাকা ধরার জন্যই খেলার বিস্তার দরকার৷ আর সেখানে পাওয়া গেল বাংলাদেশের মতো উর্বর ক্ষেত্রকে, যারা ক্রিকেটের জন্য সব সঁপে দিতে তৈরি৷ কেনিয়া-আয়ারল্যান্ড-স্কটল্যান্ডে ওসব নেই৷ তাই ওরা বাদ৷
যে কোনো কিছু পাওয়ার যোগ্য না হলেও পেতে ভালো লাগে৷ টেস্ট স্ট্যাটাসটা পেয়ে পুরো দেশ উদ্বেল ছিল৷ আবার পাওয়ার যোগ্য হয়ে ওঠার আগে কিছু পেলে সেটা সামাল দিতে কষ্ট হয়৷ সেই কষ্টটাও হতে শুরু করল কিছু দিন পরই৷ আর তাতে হৈ-চৈও উঠল৷ বাংলাদেশের একেকটা ব্যর্থতাতেই বিদেশি মিডিয়ার গেল গেল রব৷ আমরা আগেই বলেছিলাম না...। সেটা যে সামাল দেওয়া গেছে তারও কারণ দেশের মানুষ৷ সেই সূত্রে বাজার আর বাণিজ্যিক সম্ভাবনা৷ আফসোস এটাই যে এই মানুষ, বাজার, সম্ভাবনা৷এসবের শক্তি দিয়ে ক্রিকেটের নাক উঁচু অংশকে সামাল দেওয়ার কাজেই ব্যবহার করেছি শুধু৷ এই উর্বর ক্ষেত্রে টেস্টটাকে একটু পরিচর্যা করলে ৯৯তম টেস্টে শোচনীয় হারের লজ্জা নিয়ে শততম টেস্টে নামতে হয় না৷ মাহমুদ উল্লাহদের নিয়ে অত নাটক হয় না৷
বাংলাদেশ সরকারের তখনকার এক উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ক্রীড়া কর্তা টেস্ট ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছিলেন না৷ তবে রাজনীতিক যেহেতু, এবং রাজনীতিকরা না বোঝা বিষয় নিয়েই বেশি কথা বলতে পছন্দ করেন, তাই টেস্টের প্রসঙ্গ উঠলেই বলতেন, ‘‘টেস্ট মানে হচ্ছে সাগর৷ বিশাল সাগর৷''
প্রায় প্রতি বক্তৃতাই শেষ হতো টেস্ট নামের সাগরে গিয়ে৷ এবং সাংবাদিকদের হাসাহাসিতে৷ তা হাসাহাসি বাদ দিয়ে সাংবাদিকরা একদিন তাঁকে বাজিয়ে দেখতে জানতে চাইলেন, ‘‘আপনি টেস্টকে সব সময় সাগর বলেন কেন?''
‘‘আরে টেস্ট তো সাগরই৷ বিশাল সাগর৷''
‘‘আর ওয়ানডে?''
রাজনীতিক তো৷ ঝটপট জবাব, ‘‘নদী৷ নদীর মতো৷''
‘‘তাহলে ক্রিকেটের পুকুর কোনটা?''
তখন তো আর টি-টোয়েন্টি ছিল না, থাকলে উত্তর দিতে সমস্যা হতো না৷ তাঁর খুব সমস্যা হলো৷ আমতা-আমতা শুরু করলেন৷
গল্পটা বললাম এ জন্য যে, তখন আমাদের ক্রিকেট-সংস্কৃতিতে আসলে টেস্ট সম্পর্কে ‘সাগর', ‘সমুদ্র' – এই জাতীয় অস্বচ্ছ ধারণার বেশি কিছু ছিল না৷ তুলনায় ওয়ানডে অনেক পরিচিত৷ তার ধরনের সঙ্গে অনেক বেশি সখ্য৷ আর সত্যি বললে এটাই ছিল সমস্যা৷
ওয়ানডেকেন্দ্রিক কাঠামো দিয়ে টেস্ট খেলতে গিয়ে আর টেস্টের দল হয়ে ওঠা হয়নি৷ জাতীয় লিগ নামে চার দিনের প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হলো৷ সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টাও ছিল৷ কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, খেলোয়াড়দের মধ্যেও দেখেছি বড় দৈর্ঘ্যের খেলাটাকে খুব সিরিয়াসলি না নিতে৷ বরং শেষ দিনে যে ওয়ানডে হতো, তার দিকেই বেশি মনোযোগ, কারণ, এই দিন মানুষ বেশি আসে৷ হাততালি বেশি পাওয়া যায়৷ আর তাতে বিভ্রান্ত হয়ে নির্বাচনি বিবেচনাতেও বিস্তর ভুল৷ প্রাক টেস্ট যুগে জাভেদ ওমরের নামের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল ‘টেস্ট ব্যাটসম্যান'-এর লেবেল৷ অথচ যখন সত্যিকারের টেস্ট, তখন দলে নেই তিনি৷ তিন ওপেনারকে খেলানো হলো, কিন্তু তাঁদের কারো নামই জাভেদ নয়৷ সাবেক ক্রিকেটাররা সব দেশে ক্রিকেট-সংস্কৃতির অভিভাবক হিসেবে কাজ করেন৷ কিন্তু এখানেও সমস্যা৷ আমাদের সাবেকরা যেহেতু শুধুই ওয়ানডে খেলেছেন, তাই তাঁদের অভিভাবকত্বেও থাকল গোলমাল৷ আর সবশেষ টি-টোয়েন্টি এসে এমন একটা ঝোড়ো হাওয়া বইয়ে দিল যে, তারপর বাংলাদেশের মতো হুজুগে দেশে যে টেস্ট টিকে আছে সেটাই একটা বিরাট ব্যাপার৷ এবং অবশ্যই বিরাট ব্যাপার সেই দেশের শততম টেস্ট খেলতে যাওয়া৷
শ্রীলঙ্কা, শততম টেস্টের ভেন্যু পি সারা মাঠে টেস্ট কভারের অভিজ্ঞতা আছে৷ ২০০২ সালে৷ যত দূর মনে পড়ে, তখনকার রীতি অনুযায়ী ইনিংস হারই হয়েছিল৷ তখন আসলে সবখানে এটাই নিয়ম ছিল যে বিপক্ষ বিশাল একটা রানের পাহাড় গড়বে, বাংলাদেশ তাতে গড়াগড়ি খাবে৷ তিন বা সাড়ে তিন দিনে খেলা শেষ হবে অনিবার্য নিয়তি নিয়ে৷ আর সেই চোখে দেখলে উন্নতি কিন্তু মন্দ হয়নি৷ এখন যত যা-ই ঘটুক, বাংলাদেশের টেস্ট মানেই তিন দিনের মামলা নয়৷ বিপক্ষ বিরাট রান করে যে এক ইনিংসেই খেলা শেষ করে দেবে এমনও নয়৷ এই নিউজিল্যান্ডেই সাকিব-মুশফিকের ব্যাটে লিড নেওয়া গেছে৷ ভারতেও বাংলাদেশ রানচাপা না পড়ে পাল্টা গর্জন করেছে মুশফিকের অনন্য সেঞ্চুরিতে৷ এর আগে ইংল্যান্ডের সঙ্গে তো আরেকটু হলে সিরিজটা ২-০-তেই জেতা যেত৷ আর এসবই হয়েছে সঠিক কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই৷ সত্যি বললে, ওয়ানডে ক্রিকেটে সাফল্যের সূত্রে যে বিশ্বাস এসেছে, সেটাই বাংলাদেশ টেনে নিয়ে গেছে টেস্টে৷ তা ছাড়া টি-টোয়েন্টি আর ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট সূত্রে অন্য দেশেও টেস্ট ক্রিকেটের মান নামছে, রাহুল দ্রাবিড় কিংবা সাঙ্গাকারারা আর তৈরি হচ্ছেন না৷ আর এভাবে নিজেদের বিশ্বাসজনিত অগ্রগতি, অন্যদের নেমে আসা মিলিয়ে মাঝেমধ্যে টেস্টেও হয়ে যাচ্ছে৷
কিন্তু এই এক-আধটু বাতাসে স্বস্তি মেলে না যখন দেখি টেস্ট পর্যায়ে একেবারে হাস্যকর রকম ভুলে আউট হন ব্যাটসম্যান৷ টেস্ট শুধু ফলের বিষয় নয়, এই খেলার ধরনও একটা পরিণতবোধ দাবি করে৷ হয়ত বাংলাদেশ অনেক রান করছে কখনো কখনো, হয়ত জিতছেও, কিন্তু আমাদের শীর্ষ ব্যাটসম্যানরা যখন পরিস্থিতির সঙ্গে বেমানান শট নেন, তখন ক্রিকেট বিশ্ব এ জন্য হাসে যে এরা আসলে টেস্টের মানেটাই ঠিক বোঝে না! শততম টেস্টের সময় আসলে হার-জিত, পারা-না পারা নয়, টেস্টবোধের সামগ্রিক ঘাটতিটাই সবচেয়ে বেশি কষ্টের৷
এবং যতই ১০০ টেস্ট খেলি, এই কষ্ট খুব সম্ভব অদূর ভবিষ্যতে দূর হওয়ার নয়৷ কারণ, এখনো ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টি হলে আমরা যতটা ঝাঁপিয়ে পড়ি, টেস্ট এলে ততটাই নিরাসক্ত৷ এখনো সামান্য অজুহাত পেলেই টেস্টের জায়গায় তিনটি টি-টোয়েন্টি খেলার চেষ্টা করি৷ টেস্ট খারাপ করার পর বড় দৈর্ঘ্যরে ম্যাচ খেলা, প্রথম শ্রেণির কাঠামো ইত্যাদি নিয়ে যেসব কথা হয় সেগুলো আসলে স্রেফ পিঠ বাঁচানোর স্বার্থেই৷
আর এ সব দেখে দেখে ভারাক্রান্ত মনে মনে হয়, শততম টেস্ট আসলে স্রেফ একটা সংখ্যা৷ এর বেশি কিছু নয়৷ বাহারি আয়োজনের আবহ সংগীতটার মধ্যেও চাপা দুঃখের সুর৷ টেস্টকে তো আমরা ভালোই বাসিনি!
মোস্তফা মামুন, উপ-সম্পাদক, দৈনিক কালের কণ্ঠ
বন্ধু, মোস্তফা মামুনের এই লেখাটা কেমন লাগলো? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷