শবে বরাত: ধর্মীয় মোড়কে সামাজিক আচার
৮ এপ্রিল ২০২০কিন্তু দেখলাম, শবে বরাত শব্দটির সঙ্গে সে পরিচিত নয়৷ একটু অবাক হলাম৷ তারপর ভাবলাম, হয়ত তার দেশে এটিকে অন্য নামে ডাকা হয়৷ তাই বাংলাদেশে যেদিন শবে বরাত হবে সেটির আশেপাশে কোনোদিন জার্মানিতে মসজিদে বড় কিছু হবে কিনা, সেটি জানতে চাইলাম৷ কিন্তু আবারও অবাক হলাম৷ কারণ এবারও সে এমন কিছুর তথ্য দিতে পারল না৷
পরে একসময় জানলাম, শবে বরাত বিষয়টি আসলে উপমহাদেশের বিষয়! শুধুমাত্র বাংলাদেশ, ভারত আর পাকিস্তানের মুসলমানরা এদিন সারারাত মসজিদে থেকে আল্লাহকে ডাকেন৷
অনেকে হয়ত আরও আগে থেকেই এই বিষয়টি জানেন৷ কিন্তু আমি প্রথম জানার পর একটু স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছিলাম৷ কারণ আশি-নব্বইয়ের দশকে বেড়ে ওঠা আমার কাছে শবে বরাত মানে বন্ধুদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যত বেশি সম্ভব নামাজ পড়া, সারারাত মসজিদে থাকার চেষ্টা করা৷ আর তার আগে সন্ধ্যায় আটার রুটি আর হালুয়া খাওয়া৷ মজাদার এসব খাবার প্রতিবেশীদের মধ্যেও দেয়া-নেয়া চলত৷
শবে বরাতের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে ইমাম বলতেন, এই রাতে আগামী এক বছরের জন্য মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করা হয়৷ এই কথা শুনে আমরা বন্ধুরা যতটা সম্ভব এবাদতের চেষ্টা করতাম৷ এই একটা রাত কষ্ট করলে সকালে মনে হতো পুরো বছরের জন্য একটা কিছু করে ফেলেছি! অনেকে সারা রাত নফল এবাদত করে ফজরের ফরজ নামাজ না পড়েই ঘুমিয়ে পড়ত৷ অথচ নফল কখনই ফরজের সমান হতে পারেনা৷
একসময় শবে বরাত আর শবে কদরকে প্রায় একই সমান গুরুত্বপূর্ণ মনে হতো৷ কারণ বাংলাদেশে এই দুইদিনই জাতীয় ছুটি৷ এবং মুসল্লিরা এই দুইদিনই সারারাত এবাদতের চেষ্টা করেন৷
কিন্তু এখন জানি কোরানে শবে বরাত নিয়ে কিছু বলা নেই৷ অথচ শবে কদর নিয়ে একটি পুরো সূরাই আছে৷
তাহলে বাংলাদেশে শবে বরাত কীভাবে এলো? ইতিহাসবিদরা বলেন, উনিশ শতকের শেষ দিকে ঢাকার নবাবরা বড় করে শবে বরাত পালন শুরু করেন৷ তার একটা অন্যতম কারণ ছিল, হিন্দুদের আধিপত্য়ের সঙ্গে পাল্লা দেয়া৷ তাই শবে বরাতকে অনেকটা উৎসবের মোড়ক দেন মুসলিম নবাবরা৷ তারা আলোকসজ্জার ব্য়বস্থা করেন আর রুটি-হালুয়া খাওয়া শুরু করেন৷ মহানবি (সা:) যেহেতু মিষ্টি খেতে পছন্দ করতেন তাই হালুয়ার প্রচলন শুরু করেন নবাবরা৷
আর উপমহাদেশে শবে বরাত এসেছিল তারও আগে ভারতের সেই সময়কার নও-মুসলিমদের হাত ধরে৷ তাঁরা যেহেতু আগে হিন্দু ছিলেন তাই দীপাবলির কিছু আচার শবে বরাতের সঙ্গে যোগ করে দিয়েছিলেন৷ ধারণা করা হয়, এখনকার আলোকসজ্জার বিষয়টি এসেছে সেখান থেকে৷
তাহলে এবার প্রশ্ন, শবে বরাত বিষয়টি আসলো কীভাবে? আগেই বলেছি কোরানে শবে বরাতের কথা নেই৷ ‘হাসান হাদিস' নামে পরিচিত দ্বিতীয় স্তরের হাদিসে (যে হাদিস রচনার সময় বর্ণনাকারীদের স্মৃতিশক্তির দুর্বলতার প্রমাণ পাওয়া গেছে) ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বা মধ্য শাবানের রাত হিসেবে শবে বরাতের উল্লেখ আছে৷ অর্থাৎ হিজরি শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত৷ এই রাতে আল্লাহ মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত তাঁর সৃষ্টির সকলকে ক্ষমা করেন বলে ঐ হাদিসে উল্লেখ আছে৷
ইসলামের ইতিহাস থেকে জানা যায়, আজ থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগে (সম্ভবত ৪৪৮ হিজরিতে, এখন চলছে ১৪৪১ হিজরি) মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে শবে বরাত পালিত হতো৷ এরপর একসময় তা বন্ধ হয়ে যায়৷
তবে ইরানের শিয়ারা এই দিন ইমাম মাহাদির জন্মদিন পালন করে থাকে৷ তাই ইরানে আজও সেটি সরকারি ছুটির দিন এবং এদিন আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে৷
ভারতের নও-মুসলিমরা ইরানের শিয়াদের কাছ থেকে শবে বরাতের রীতি গ্রহণ করায় আজও আমরা বাংলাদেশে সেভাবে শবে বরাত পালন করে থাকি৷
তবে করোনা ভাইরাসের কারণে সরকার এবছর সবাইকে ঘরেই শবে বরাতের এবাদত করার পরামর্শ দিয়েছেন৷ তাই এবার আর সবসময়ের মতো মসজিদে গিয়ে সারারাত নামাজ পড়া হবে না৷ কিন্তু তাতে মনে কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই৷ কারণ শবে বরাত আসলে ধর্মীয় মোড়কে একটি সামাজিক আচার, যা একবছর পালন না করলে কোনো পাপ হবে না৷