শারদীয় ‘দুর্গোৎসব’ নয়, এবার ‘দুর্গাপূজা’
১৯ অক্টোবর ২০২০এমনকি অষ্টমী তিথির কুমারী পূজাও এবার ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বড় শহরগুলোতে বাদ দেওয়া হয়েছে৷ রাত নয়টার পর দেশের কোন পূজামণ্ডপ খোলা রাখা যাবে না৷ হবে না সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও৷ দর্শনার্থী প্রবেশেও থাকবে কড়াকড়ি৷
উৎসব বাদ দিয়ে শুধু পূজার এই আয়োজন কি সরকারি নির্দেশনার কারণে? জানতে চাইলে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এবার পূজার সংখ্যা কমানোর জন্য সরকারি তরফ থেকে তো এক ধরনের নির্দেশনা ছিলই৷ কিন্তু পূজা নিয়ে যে সিদ্ধান্তগুলো এসেছে এগুলো আমরাই ঠিক করেছি৷ এখানে সরকারের চাপিয়ে দেওয়া কিছু নেই৷ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি৷ সেখানেও এগুলো আলোচনা হয়েছে৷ আসলে করোনা অতিমারীর কারণে অনেক দিন আগে থেকেই আমরা বলছি, এবার উৎসব করা যাবে না৷ শুধু পূজাটিই করতে হবে৷’’
এবার প্রতিমা বিসর্জন নিয়ে রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘অন্য বছরগুলোতে তো আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে শোভাযাত্রা করে প্রতিমা নিয়ে একটা জায়গায় যেতাম৷ সেখানে সবাই মিলিত হয়ে একসঙ্গে বিসর্জন দেওয়া হতো৷ কিন্তু এবার এই মহামারীর কারণে কেউ একসঙ্গে যাবেন না৷ প্রতিটি মণ্ডপ থেকে পৃথকভাবে প্রতিমা নিয়ে বিসর্জন দেওয়া হবে৷’’
গত শনিবার ঢাকেশ্বরী মন্দিরে এক মতবিনিময় সভায় বাংলাদেশ পূজা উৎযাপন পরিষদের সভাপতি মিলন কান্তি দত্ত বলেছেন, ‘‘করোনা ভাইরাস মহামারীর কারণে এবার আমরা কুমারী পূজা করব না৷ তবে ঢাকার বাইরে কয়েকটি জায়গায় কুমারী পূজা হতেও পারে৷ মহামারীর কারণে সংক্রমণ এড়াতে এবছর বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানও সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে৷ এবছর দুই-একটি জায়গা ছাড়া খুব বেশি প্রতিমা ভাঙচুরের খবর পাওয়া যায়নি বলে জানান তিনি৷’’
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল কুমার চ্যাটার্জী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘করোনা অতিমারীর কারণে এবার উৎসব সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো পরিহার করে সাত্ত্বিক পূজায় সীমাবদ্ধ রাখতে হবে বিধায় এবারের দুর্গোৎসবকে ‘দুর্গাপূজা’ হিসেবে অভিহিত করছি৷ এটা চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়৷ চীনে একজন থেকে সারাবিশ্বে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে৷ ফলে আমরা নিজেরাও এ ব্যাপারে সচেতন৷ আমার কাছে আমার নিজের জীবন বা পরিবারের জীবন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি দেশের প্রতিটি মানুষের জীবন গুরুত্বপূর্ণ৷ এই কারণে প্রতিটি মণ্ডপে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে৷’’
কুমারী পূজা কেন হচ্ছে না, এটা তো পূজারই অংশ? জবাবে নির্মল চ্যাটার্জি বলেন, ‘‘আমরা তো কুমারী পূজার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেইনি৷ এটা রামকৃষ্ণ মিশন থেকে এসেছে৷ কলকাতার রামকৃষ্ণ মিশনেও কুমারী পূজা হচ্ছে না৷ ফলে ঢাকার এরাও করবে না৷ কারণ এই পূজার সঙ্গে অনেক আবেগ জড়িত৷ পৃথক প্যান্ডেল করে রামকৃষ্ণ মিশনে এই পূজা হয়৷ এবার তারা আলাদা কোন প্যান্ডেল করেনি৷ শুধু মন্দিরেই পূজা হচ্ছে৷ ফলে পূণ্যার্থীদের সামাল দেওয়া কঠিন হবে৷ তবে যশোর, নড়াইল, ময়মনসিংহসহ কয়েকটি রামকৃষ্ণ মিশনে কিন্তু কুমারী পূজা হবে৷ কারণ ওই প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রচুর জায়গা আছে৷ ঢাকার বাইরে কেউ যদি স্বপ্ল পরিসরে কুমারী পূজা করতে চায় তাহলে তারা করতে পারবেন৷’’
কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্তের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে চট্টগ্রাম মহানগরীতেও কোন কুমারী পূজা হবে না৷ বাংলাদেশ পূজা উৎযাপন পরিষদের চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট চন্দন কুমার তালুকদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় কমিটি যেহেতু সিদ্ধান্ত দিয়েছে এবার কুমারী পূজা করা যাবে না, সেই সিদ্ধান্ত মেনে আমরাও কুমারী পূজা করছি না৷ চট্টগ্রাম মহানগরের ২৭৬টি পূজা মণ্ডপের একটিতেও কুমারী পূজা হবে না৷ কেন্দ্রীয় কমিটি আমাদের যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছে, আমরা সেগুলো মেনেই পূজার আয়োজন করেছি৷ বিশেষ করে স্বাস্থ্য বিধির ব্যাপারে আমরা কঠোর থাকব৷’’
দূর্গাপূজার সময় বিশেষ করে সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী তিথিতে পূজা মণ্ডপগুলোতে মানুষের উপচেপড়া ভিড় দেখা যায়৷ এই ধরনের ভিড় হলে কিভাবে সামাল দেবে মণ্ডপগুলো? জানতে চাইলে রমনা কালী মন্দির কমিটির সভাপতি উৎপল দত্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এবার বিশাল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করা হয়েছে৷ আমরা রমনা কালী মন্দির থেকে দুই লাখ মাস্ক বিতরণ করব৷ গেটে স্বাস্থ্যবিধির পুরো ব্যবস্থাই থাকবে৷ আমরা এবার বলেছি, নো মাস্ক, নো এন্ট্রি৷ কেউই মাস্ক বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার না করে মন্ডপে প্রবেশ করতে পারবেন না৷ একসঙ্গে বেশি মানুষ এলেও আমরা নির্দিষ্ট সংখ্যক দর্শনার্থীর বেশি ভেতরে ঢুকতে দেব না৷ দর্শনার্থীদের কেউই বেশিক্ষণ মণ্ডপে থাকতে পারবেন না৷’’
এবার মহালয়া হয়ে গেছে গত ১৭ সেপ্টেম্বর৷ কিন্তু পঞ্জিকার হিসাবে এবার আশ্বিন মাস ‘মল মাস’, মানে অশুভ মাস৷ সে কারণে এবার আশ্বিনে দেবীর পূজা না হয়ে তা হচ্ছে কার্তিক মাসে৷ পঞ্জিকা অনুযায়ী, ২২ অক্টোবর মহাষষ্ঠী তিথিতে হবে বোধন, পরদিন সপ্তমী পূজার মাধ্যমে শুরু হবে দুর্গাপূজার মূল আচার অনুষ্ঠান৷ ২৬ অক্টোবর মহাদশমীতে বিসর্জনে শেষ হবে দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা৷ পূজা উদযাপন পরিষদের হিসাব অনুযায়ী, গত বছর সারাদেশে ৩১ হাজার ৩৯৮টি মণ্ডপ দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ এবার এই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ২২৫টি৷ এর মধ্যে ঢাকায় ২৩১ মন্ডপে পূজা হচ্ছে৷ গত বছর পূজা হয়েছিল ২৩৯টি মণ্ডপে৷