শিক্ষকই যেখানে ধর্ষক!
২২ নভেম্বর ২০১৭ভারত সরকার ফলাও করে ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও' অভিযান শুরু করেছে৷ ১৬১টি জেলায় এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে ইতিমধ্যেই৷ সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী, এক ঢিলে দুই পাখি মারার লক্ষ্যে এই প্রকল্প৷ এর মাধ্যমে যেমন কন্যা ভ্রূণহত্যা রোখা যাবে, বাল্যবিবাহে নিয়ন্ত্রণ আনা যাবে, তেমনই মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটানো যাবে৷ অথচ সরকারের প্রকল্পে যখন প্রগতির ভাবনা, তখন বাস্তবে এমন ঘটনা ঘটে চলেছে, যা স্তম্ভিত করে দিচ্ছে সমাজকে৷ শিক্ষার পরিবেশ যেমন এতে বিপন্ন হচ্ছে, তেমনই শিক্ষক-ছাত্রের চিরন্তন যে সম্পর্ক, তা-ও বিপন্ন হয়ে উঠছে৷ সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় জীবনের সব অংশকেই ক্রমশ গ্রাস করছে৷ শিক্ষাঙ্গন আর তার বাইরে থাকবে কী করে!
এই সমস্যার অন্ততর্দন্ত করার আগে সেই ঘটনাগুলির দিকে এক নজর রাখা দরকার যা আমাদের বিবেককে নাড়া দিয়েছে৷ প্রথমেই বলব সোনারপুরের কথা৷ পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার এই মফস্বল শহরে এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছে তারই শিক্ষক৷ নবম শ্রেণির ছাত্রী ওই কিশোরী স্কুলের আংশিক সময়ের শিক্ষক বাবলুবরণ ঘোষের কাছে আলাদা করে পড়ত৷ পরীক্ষায় ভালো নম্বরের টোপ গিলিয়েই ছাত্রীকে একাধিকবার ধর্ষণ করেন অভিযুক্ত শিক্ষক৷ ছাত্রীর পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ পরে পাকড়াও করেছে নরাধমকে৷
এরপরে বলতে হয় ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার কথা৷ ছাত্রীটি যখন বার্ষিক পরীক্ষায় বসতে চায়, তখন সবচেয়ে বেশি বাধা দেন প্রধান শিক্ষিকাই৷ ছাত্রীর পরিবারের দাবি, শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে না নিলে মেয়েকে যে পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হবে না, সে কথা সাফ জানিয়ে দেন প্রধান শিক্ষিকা৷ এমনকি, স্কুলের দরজাও তার সামনে বন্ধ করে দেওয়া হয়৷ এভাবেই ধর্ষণে অভিযুক্ত শিক্ষককে আড়াল করে ফতোয়া জারি করা হয় ছাত্রীর উপরেই!
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফতোয়ার নজির অবশ্য এই প্রথম নয়৷ স্কুল কলেজে তথাকথিত ভদ্র-সভ্য পোশাকের জিগির তুলে ফতোয়া জারি হয়েছে এর আগেও৷ কিন্তু ২০১৭ সালের এপ্রিলে ধর্ষিতা ছাত্রীকে স্কুলে না আসার ফতোয়া জারির নিদর্শন মিলেছে খোদ রাজধানী দিল্লিতেও৷ দশম শ্রেণির এক ছাত্রীকে অপহরণ করার পর ধর্ষণ করে চলন্ত গাড়ি থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল সে সময়৷ এই ঘটনার পরে ছাত্রীটির পাশে স্কুলের দাঁড়ানো তো দূরের কথা, উল্টে স্কুলের ভাবমূর্তি রক্ষায় সচেষ্ট কর্তৃপক্ষ মেয়েটিকে জানায় যে, তাকে পরের শ্রেণিতে তুলে দেওয়া হবে৷ কিন্তু তার ক্লাসে এসে পড়াশোনা করার দরকার নেই৷ চূড়ান্ত অসংবেদনশীল হিসেবে স্কুল কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিয়েছিল, স্কুলে এলে মেয়েটির নিরাপত্তার ব্যাপারে কোনো দায়িত্ব নেওয়া হবে না৷ এমনকি, সে স্কুল বাসও ব্যবহার করতে পারবে না৷ অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানের মানমর্যাদা বজায় রাখতে তার না আসাই বাঞ্ছনীয়!
ছাত্রীর বিপন্ন অভিভাবকরা এ সবের প্রতিকার চাইতে দ্বারস্থ হয়েছিলেন দিল্লির মহিলা কমিশনের কাছে৷ এই ঘটনা প্রমাণ করছে, নিগৃহীতা ছাত্রীকে অশুচি বলে মনে করছে কর্তৃপক্ষ৷ সে স্কুলে এলে অন্য ছাত্রীদের পবিত্রতা নষ্ট হবে৷ একইসঙ্গে তাদের ধারণা, ধর্ষিতাকে পঠন-পাঠনের সুযোগ করে দেওয়ার অর্থ প্রতিষ্ঠানের মর্যাদাহানি৷ যে সময় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছাত্রীর পাশে দাঁড়ানো দরকার, তখনই তাকে ব্রাত্য করে দেওয়া হচ্ছে৷ এটা যদি শিক্ষার সঙ্গে জড়িত মানুষদের ভাবনাচিন্তার অভিমুখ হয়, তা হলে বাকি সমাজ কোথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে, এটা ভাবার চেষ্টা করলে শঙ্কিত হতে হয়৷
সমাজ-সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এই ধরনের বিতর্কে ভিন্নমত উঠে আসার সুযোগ তৈরি হয়েছে৷ সকলে বিষয়টিকে একপাক্ষিক বলে মানতে রাজি নন৷ তাঁরা প্রশ্ন তুলছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয় কি শুধু শিক্ষকের? এই প্রশ্নে ছাত্রীদের দিকেও আঙুল উঠছে৷ আঙুল তুলছেন শিক্ষা জগতের মানুষরাই৷ সোনারপুরের ঘটনাকে নমুনা হিসেবে না ধরেও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত ছাত্রীদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন উত্তর ২৪ পরগনার নৈহাটিতে ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র কলেজ ফর উইমেন-এর অধ্যক্ষা ড. লনা মুখোপাধ্যায়৷ শিক্ষকদের ভূমিকার চরম নিন্দা করে ছাত্রীদের সম্পর্কে বিস্ফোরক কথা বলেছেন অধ্যক্ষা৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘সবক্ষেত্রে বিষয়টা একপাক্ষিক নয়৷ ছাত্রীরাও সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষকই দায়ী, এটা মেনে নিলেও, কোনো কোনো ঘটনায় পড়ুয়ার ভূমিকা নেই, এটা বলা যায় না৷''
এ ব্যাপারে অধ্যক্ষা গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন নিজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘অনেক ছাত্রী কলেজেই আসে না৷ সেই ফাঁক পূরণ করতে তারা শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ করে৷ আর সেই সূত্রে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে৷ শিক্ষক সেই সুযোগ নিলে তাঁকে অপরাধী বলব নিশ্চয়ই, কিন্তু যে ছাত্রী সুযোগ করে দিচ্ছে, তার কথাও বলতে হবে৷'' দীর্ঘদিন অধ্যাপনার সঙ্গে জড়িত ড. লনা মুখোপাধ্যায়ও একে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় বলে মনে করছেন — সে শিক্ষকই হোন, বা পড়ুয়া৷ তাঁর কথায়, ‘‘শিক্ষার্থীরা কোন পরিবার থেকে আসছে, তারা কী ধরনের শিক্ষা পেয়ে বড় হয়েছে, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ৷ তাদের মধ্যে মূল্যবোধ তৈরির দায় শিক্ষককেরও রয়েছে৷ কিন্তু বাড়ি থেকেই এটা শুরু হয়৷ তার ভিত জোরালো হলে মূল্যবোধের অবক্ষয়জনিত এ সব ঘটনা ঘটবে না৷ একই কথা শিক্ষকের ক্ষেত্রেও বলা যায়৷''
লনা মুখোপাধ্যায় যে ভাইরাস কলেজ স্তরে দেখছেন, তা কি স্কুল স্তরেও প্রবেশ করেছে? সোনারপুরের ছাত্রীটি কি পড়াশোনার বদলে শিক্ষকের অবৈধ অনুগ্রহে ভালো ফল করতে চেয়েছিল? নিগ্রহের পর কোনো ছাত্রীর সামনে এই প্রশ্ন রাখা সমীচীন নয়৷ কিন্তু এ সব ঘটনার দীর্ঘমেয়াদি তদন্তে এই প্রশ্ন উঠে আসতেই পারে৷ নইলে অবক্ষয়ের সামগ্রিক চিত্রটি ধরার ক্ষেত্রে ফাঁক ও পক্ষপাত থেকে যেতে পারে৷
একটি এলাকায় একাধিক ঘটনা ঘটলে অনেক সময় অনুমান করা হয়, সেটা ঐ অঞ্চলের প্রবণতা৷ সোনারপুর থানা এলাকার একাধিক ঘটনা নিয়ে সেই প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে৷ যদিও একাধিক ছাত্রী নিগ্রহের সঙ্গে স্থানীয় কোনো ফ্যাক্টরকে জুড়তে রাজি নন সোনারপুর মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ উজ্জ্বল রায়৷ শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্কের মধ্যে এলাকাগত ভাবে কোনো অস্বাভাবিকতা দেখছেন না তিনি, বা সেই ধরনের নেতিবাচক পরিবর্তন হওয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি৷ তাই এগুলিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবেই তিনি দেখছেন৷ উজ্জ্বল রায় বলেন, ‘‘সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়েছে ঠিকই, তবে পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়নি৷ তাই শিক্ষক-পড়ুয়ার সম্পর্ক একেবারে খারাপ হয়ে গেছে, এ কথা বলা যাবে না৷''
তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমার কলেজে উভয়ের সম্পর্ক বেশ ভালো৷ বাইরের ঘটনা নিয়ে বলার এক্তিয়ার আমার নেই৷ তবে এ ধরনের কোনো প্রবণতা সোনারপুরের এই কলেজে আমি দেখিনি৷'' মূল্যবোধের অবক্ষয় রুখতে শিক্ষকদের কি কোনো ভূমিকা রয়েছে? উজ্জ্বল রায় বলেন, ‘‘অনেক শিক্ষকই তাঁদের ভূমিকা পালন করতে চেষ্টা করেন৷ তাতেই কি সমস্যা মিটবে? আমরা নৈতিকতার পাঠ দিই ছাত্রছাত্রীদের৷ কিন্তু তাতে কতটা কাজ হচ্ছে, সে ব্যাপারে আমার সংশয় রয়েছে৷ এটা সার্বিক অবক্ষয়ের প্রশ্ন, শুধু শিক্ষকদের হাতে সবটা নয়৷''
দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ড গোটা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল৷ পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে একই আলোড়ন তুলেছিল উত্তর ২৪ পরগনার কামদুনিতে স্কুলছাত্রীর ধর্ষণ ও হত্যা৷ অপরাধীদের সাজার ঘোষণা করেছে আদালত৷ কিন্তু ধর্ষণের অভিশাপ থেকে মুক্তি মেলেনি৷ উল্টে শিক্ষক ও পড়ুয়ার সুন্দর সম্পর্ককে কলুষিত করে দিচ্ছে যৌন নিগ্রহের মতো ঘটনা৷
প্রতিবেদনটি কেমন লাগলো বন্ধু? জানান আমাদের, লিখুন নীচে, মন্তব্যের ঘরে৷