ঢাকার কাছেরই একটা নামকরা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক তিনি। নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলছিলেন, ‘‘আমি যেমন শিক্ষক আবার একইসঙ্গে অভিভাবক। আমার মেয়েও স্কুলে পড়ে। নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে আমি বেশ দ্বিধা-দ্বন্দে আছি।’’
কারণ জানাতে গিয়ে বলছিলেন, ‘‘এই শিক্ষাক্রমে অনেক কিছু যেমন ভালো, তেমনি অনেক বিষয় নিয়ে শিক্ষকরা এখনো ধোঁয়াশায় আছেন। অনেকে প্রশিক্ষন পাননি। শিক্ষক সংকট আছে। আছে যোগ্য শিক্ষকের অভাব। বিশেষ করে শিক্ষকরা কী করে ক্লাসের প্রত্যেকটা ছেলে-মেয়ের মূল্যায়ন কী করে হবে, সেটি নিয়েও শিক্ষকরা ধোঁয়াশায় আছেন। তবে পরীক্ষা নেই বলে ছেলে-মেয়েরা কিন্তু বেশ খুশি। আনন্দ নিয়েই তারা ক্লাসে নানা কাজ করছে। কিন্তু সন্ধ্যার পর পড়তে বসছে না বলে অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন।’’
নারায়ণগঞ্জের বন্দর এলাকার প্রায় চার দশকের পুরোনো এই স্কুলটি ঘুরে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে বসেই কথা হচ্ছিল। তিনি বলছিলেন, ‘‘নিজে প্রধান শিক্ষক বলে অনেক কিছু প্রকাশ্যে বলতে পারি না। তবে বাস্তবতা হলো, নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে সবচেয়ে বেশি দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আছেন শিক্ষক ও অভিভাবকরা। আরেকটু সময় নিয়ে, আরো বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এটি শুরু করলে ভালো হতো। তবে যেহেতু চালু হয়ে গেছে এখন সারা দেশের অভিজ্ঞতাগুলো কাজে লাগিয়ে প্রতিনিয়ত সমন্বয় করা জরুরি। এক্ষেত্রে অভিভাবক, শিক্ষক, সরকার সবাইকে উদার হতে হবে।''
২০২৩ সালে দেশের সব প্রাথমিক স্কুলে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি এবং মাধ্যমিকে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে চালু হয়েছে নতুন এই শিক্ষাক্রম। ২০২৪ সালে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম এবং নবম শ্রেণি যুক্ত হবে নতুন শিক্ষাক্রমের তালিকায়। এরপর ২০২৫ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের সব স্কুল নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় চলে আসবে। পর্যায়ক্রমে ২০২৬ ও ২০২৭ সালে এই পদ্ধতি চালু হবে উচ্চ মাধ্যমিকে।
এই শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের পাঠগ্রহণ যুগোপযোগী, কার্যকর ও আনন্দময় করতে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা না রাখা, নবম-দশম শ্রেণিতে বিভাগভিত্তিক বিভাজন তুলে দেওয়া, এসএসসির আগে পাবলিক পরীক্ষা না নেওয়াসহ অনেক পরিবর্তন আনা হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রমে। এর ফলে আনন্দময় পড়ার পরিবেশ তৈরি হবে। মুখস্থনির্ভরতার পরিবর্তে দক্ষতা, জ্ঞান ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে শিখতে পারবে শিক্ষার্থীরা।
সরকারের নানা দপ্তর নতুন এই শিক্ষাক্রমকে যুগোপযোগী বললেও অভিভাককদের অধিকাংশই এখন উদ্বিগ্ন। সারাজীবন স্কুল-কলেজে পরীক্ষা দিয়ে আসা এই অভিভাবকদের অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, ভাত রান্না শিখতে স্কুলে যেতে হবে কেন? নতুন শিক্ষাক্রমে নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, বাণিজ্য বা মানবিক শাখা নির্বাচনের সুযোগ নেই কেন এমন প্রশ্নও করছেন তারা? তবে অভিভাবকরা সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন পরীক্ষা না থাকা নিয়ে। তাদের কথা, পরীক্ষা না থাকলে তো ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া করবে না। ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, চাকুরি এসব নিয়েও উদ্বিগ্ন অভিভাকরা।
এসব কথা যে কেবল সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেই আসছে তা-ই নয়, রাজপথেও নেমেছেন একদল। এই যেমন গত ১৯ অক্টোবর নতুন শিক্ষাক্রম সংস্কার ও পরীক্ষা পদ্ধতি চালুর দাবিতে রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনের সড়কে ‘অভিভাবকদের’ ব্যানারে একটি মানবন্ধন হলো। তাতে নতুন শিক্ষাক্রম বাতিল, ৫০-৬০ নম্বরের অন্তত দুটি সাময়িক লিখিত পরীক্ষা চালু রাখা, ত্রিভুজ-বৃত্ত-চতুর্ভূজসহ সব ধরনের চিহ্নভিত্তিক ফল পদ্ধতি বাতিল করে নম্বর ও গ্রেডিং ভিত্তিতে মূল্যায়ন, শিক্ষার্থীদের দলগত কাজে মোবাইলসহ ডিভাইসমুখী হতে নিরুৎসাহিত করে অধ্যয়নমুখী করাসহ নানা দাবি উঠেছে।
এসব দাবি বাস্তবায়নে বিভিন্ন স্কুলের সামনে মানববন্ধন, আলোচনা সভা, স্কুলে স্কুলে জরিপ কার্যক্রম, ছাত্র-শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষাবিদ, গবেষকদের সঙ্গে মতবিনিময়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে স্মারকলিপি প্রদানসহ নানা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। ২৪ নভেম্বর নতুন শিক্ষাক্রম বাতিলের দাবিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মানববন্ধন কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে অভিভাবকদের সংগঠন ‘সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলন।
অভিভাবকরা বলছেন, নিত্যনতুন পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে তারা রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন। অবশ্য হিমশিম অবস্থা না হওয়ার কারণ নেই! এই দেশের একটা শিক্ষানীতিও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। স্বাধীনতার পর কথা ছিল শিক্ষা হবে একমুখী, সর্বজনীন ও অবৈতনিক। ড. কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টেও তা উল্লেখ ছিল। অথচ দেশে নানামুখী শিক্ষাব্যবস্থা।
২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষা হবে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। আর মাধ্যমিক স্তর হবে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত। এ জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতাসম্পন্ন বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। কিন্তু শিক্ষানীতির এসব আজও বাস্তবায়ন হয়নি। বরং জোড়াতালি দিয়ে সব চলছে। কখনো সৃজনশীল ব্যবস্থা, কখনো পিএসসি, জেএসসি পরীক্ষাসহ নিত্যনতুন পরীক্ষার তো শেষ নেই! ফলে অভিভাবকদের উদ্বিগ্ন হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। এর আগে ২০১০ সালে যে সৃজনশীল পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছিল, ছাত্র-শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সেই পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত করানো ছিল বিশাল কঠিন কাজ। পরে দেখা গেল, সৃজনশীল পদ্ধতিও কোচিং সেন্টার ও গাইড নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে।
নতুন শিক্ষাক্রমে তৃতীয় শ্রেণির আগে স্কুলে কোনো পরীক্ষা রাখা হয়নি। বলা হচ্ছে, এই ক্লাসগুলোতে পুরোটাই হবে শিখনকালীন মূল্যায়ন। এরপর চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান- এই বিষয়গুলোয় শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ, আর সামষ্টিক মূল্যায়ন (বার্ষিক পরীক্ষা) হবে ৪০ শতাংশ। একইভাবে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ। বাকি বিষয়গুলোয় সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৪০ শতাংশ। এ ছাড়া জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতির মতো বাকি বিষয়গুলোর শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ১০০ শতাংশ।
নবম ও দশম শ্রেণিতে গিয়ে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন ৫০ শতাংশ আর সামষ্টিক মূল্যায়ন ৫০ শতাংশ। অর্থাৎ দশম শ্রেণির মোট ১০টি বিষয়ের মধ্যে পাঁচটির পরীক্ষা হবে এসএসসিতে। বাকি বিষয়গুলোয় ১০০ শতাংশ শিখনকালীন মূল্যায়ন। বর্তমানে নবম ও দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে এসএসসি পরীক্ষা হয়। এখন গড়ে ৩২ কর্মদিবস লাগে এসএসসি পরীক্ষা নিতে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হলে পাঁচ কর্মদিবসেই পরীক্ষা নেয়া শেষ হবে।
অভিভাবকরা প্রশ্ন তুলেছেন, এত দিন একজন শিক্ষার্থী বিজ্ঞান, মানবিক নাকি ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে পড়বে, সেটি ঠিক হতো নবম শ্রেণিতে। এখন সেটি কেন থাকবে না? যদিও বিশ্বের অন্তত ৭০ শতাংশ দেশে মাধ্যমিক পর্যন্ত কোনো বিভাগ বিভাজন নেই, তবুও বাংলাদেশে এতোদিন নবম শ্রেণিতে তিন ভাগে বিভাজন হতো। এখন থেকে আর সেটি থাকবে না। নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে ২০২৬ সালে এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। তখন শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচিতে হবে এসএসসির এই পরীক্ষা।
এরপর একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে বোর্ডের অধীনে দুটি পরীক্ষা হবে। উচ্চ মাধ্যমিকে (একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি) ছয়টি বিষয়ে ১২টি পত্র থাকবে। একাদশ শ্রেণিতে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে বাংলা, ইংরেজি ও ডিজিটাল প্রযুক্তির পাশাপাশি একজন শিক্ষার্থী যে শাখায় পড়বে, সেই শাখার প্রতিটি বিষয়ের প্রথম পত্রের (মোট তিনটি) পরীক্ষা হবে। অর্থাৎ, একাদশ শ্রেণিতে মোট ছয়টি বিষয়ে পাবলিক পরীক্ষা হবে।
আর দ্বাদশ শ্রেণিতে নিজ নিজ শাখার তিনটি বিষয়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পত্রের মোট ছয়টি বিষয়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির সম্মিলিত ফলের ভিত্তিতে উচ্চ মাধ্যমিকের চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করা হবে। রূপরেখা অনুযায়ী, একাদশ ও দ্বাদশে আবশ্যিক বিষয়গুলোয় শিখনকালীন মূল্যায়ন ৩০ শতাংশ আর সামষ্টিক মূল্যায়ন ৭০ শতাংশ। প্রায়োগিক বা ঐচ্ছিক বিষয়গুলোয় শিখনকালীন মূল্যায়ন ১০০ শতাংশ। এই দুই শ্রেণিতে সামষ্টিক মূল্যায়নের পাশাপাশি প্রকল্প ও ব্যবহারিক ভিত্তিতেও শিখনকালীন মূল্যায়নের সুযোগ থাকবে।
নতুন শিক্ষাক্রমে গতানুগতিক পরীক্ষা পদ্ধতির বদলে শিখনকালীন মূল্যায়নের দিকে নজর দেওয়া হয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ও শিক্ষা দপ্তরের লোকজন বলছেন, তাদের মূল্যায়ন হচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রমকে শিক্ষার্থীরা খুব ভালোভাবে নিয়েছে। মুখস্থ করার বদলে গ্রুপভিত্তিক কাজ করাটাও তারা ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছে। পরীক্ষা ভীতির বদলে আনন্দ নিয়েই শিখছে তারা।
তবে অভিভাবকরা আলু ভর্তা কিংবা ভাত-ডাল রান্না নিয়ে হাসি–ঠাট্টাই করছেন। অথচ রান্না শেখাটা জীবনের জন্য জরুরি। আর শুধু রান্না নয়, শিক্ষার্থীরা যে প্রাথমিক চিকিৎসার পাঠ নিচ্ছে, রাস্তা পার হওয়া শিখছে এগুলোর প্রত্যেকটাই কিন্তু জরুরি। আমাদের দেশে বহু ছেলে-মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক করে কিন্তু যোগাযোগ ও অন্যান্য দক্ষতার যথেষ্ট ঘাটতি। কাজেই নতুন শিক্ষাক্রমে এগুলো শিখলে মন্দ কী? তবে এখানে চ্যালেঞ্জটা অন্য জায়গায়। আর সেটা শিক্ষকদের ঘিরেই।
বিশেষত, নতুন শিক্ষাক্রমে শিখনকালীন মূল্যায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, শিক্ষার্থী কতটুকু শিখলো, তা নিয়মিত ক্লাসে যাচাই করা হবে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীর দুর্বলতা যাচাই করে প্রত্যেককে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করার কথা শিক্ষকদের। মুশকিলটা এখানেই। কী করে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ভালোভাবে নজর দেবেন শিক্ষকরা? কী করে সবাইকে সমানভাবে মূল্যায়ন করবেন? কারণ, বাংলাদেশে এখনো শ্রেণিভেদে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত অনেক বেশি।
২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী, ২০১৮ সালের মধ্যে মাধ্যমিকে গড়ে প্রতি ৩০ শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষকের ব্যবস্থা করার কথা ছিল। কিন্তু মাধ্যমিকে এখন গড়ে ৩৮ শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক রয়েছেন। তবে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এই অনুপাত আরও বেশি। সেখানে গড়ে ৫২ শিক্ষার্থীকে পড়ান একজন শিক্ষক। শুধু তা-ই নয়, কোনো কোনো বিদ্যালয়ে একেকটি শ্রেণিকক্ষে ৬০ থেকে ৭০ শিক্ষার্থী নিয়েও শিক্ষকদের ক্লাস করতে হয়। প্রাথমিকেও গড়ে ৩৮ শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক রয়েছেন। অথচ নতুন শিক্ষাক্রম সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর উপর নজর দিতে হবে। এটি বিরাট একটা চ্যালেঞ্জ।
এনসিটিবি সমীক্ষায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের যে চিত্র তুলে ধরেছে, তাতে দেখা যায়, যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম থাকা সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় গড়ে ১২ শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক রয়েছেন। থাইল্যান্ডে গড়ে ২৪ শিক্ষার্থীর জন্য একজন, ইন্দোনেশিয়ায় ১৫ শিক্ষার্থীর জন্য একজন, কম্বোডিয়ায় ২৯ শিক্ষার্থীর জন্য একজন, অস্ট্রেলিয়ায় ৯ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন, ফিনল্যান্ডে গড়ে ১৩ শিক্ষার্থীর জন্য একজন এবং ডেনমার্কে ১১ শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক রয়েছেন। অন্যদিকে ভারতে গড়ে ২৮ শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক রয়েছেন।
নতুন কারিকুলাম ফিনল্যান্ডের আদলে করা হয়েছে এমন আলোচনা আছে। তবে ফিনল্যান্ড, কিংবা সিঙ্গাপুর কিন্তু শিক্ষায় বিশ্বসেরা হিসেবে স্বীকৃত। সেখানে শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নকে খুবই গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফিনল্যান্ডে শিখনের ক্ষেত্রে গঠনকালীন মূল্যায়নকে গুরুত্ব দেয়। শিক্ষার্থীদের ওপর থেকে পরীক্ষাভীতি বা মানসিক চাপ কমাতে পাবলিক পরীক্ষার গুরুত্ব কম। সেখানে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে স্বতন্ত্রভাবে বিবেচনায় নিয়ে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত এত বেশি যেখানে এক ক্লাসে ৬০ থেকে আশিজন বা অরো বেশি শিক্ষার্থী সেখানে সবাইকে কী করে স্বতন্ত্রভাবে বিবেচনায় আনা যাবে?
শিক্ষকরা রাখ ঢাক না করেই বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রম, নতুন পাঠ্যপুস্তক, শিখন-শিক্ষণ, মূল্যায়ন পদ্ধতিসহ নানা বিষয় নিয়ে অধিকাংশ শিক্ষকের ধারণা এখনো স্পষ্ট নয়। তাঁরা এই শিক্ষাক্রম ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারছেন না। এখনো অনেক শিক্ষক প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন না। অনেকে প্রশিক্ষণ পেলেও বুঝতে পারছেন না। এমনকি সময়মতো শিক্ষক সহায়িকাও তাঁদের হাতে আসছে না। কাজেই সবার আগে নতুন পদ্ধতি ভালোভাবে শিক্ষকদের বোঝাতে হবে। ধারাবাহিকভাবে প্রশিক্ষণের পর প্রশিক্ষণ দিতে হবে। দরকার দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ।আবার শহর ও গ্রামে নানা বৈষম্য আছে। কাজেই নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত ও মেধাবী শিক্ষকদের নিয়োগের যেমন ব্যবস্থা করতে হবে, তেমনি তাঁদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে।
মনে রাখতে হবে, দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষা খাতে বাংলাদেশে বরাদ্দ যেমন কম, তেমনি কম শিক্ষকদের বেতন-ভাতাও। এসব কারণেই এখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেধাবীরা শিকক্ষতা পেশায় আসেন না। কাজেই মেধাবীদের আনতে হলে তাদের যথাযথ সম্মান ও সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে সব স্তরের শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতনকাঠামো প্রণয়ন করার কথা বলা হয়েছিল। শিক্ষানীতি প্রণয়নের ১৩ বছর হতে চললো। এগুলো বাস্তবায়নে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই।
জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটির সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইআর)-এর অধ্যাপক এম তারিক আহসান গণমাধ্যমে বলেছেন, শিক্ষকের তুলনায় শিক্ষার্থী বেশি হলে স্বাভাবিকভাবেই সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করা কঠিন হয়। দেশে এখনো অনেক শ্রেণিকক্ষে ৭০ জনের বেশি শিক্ষার্থী আছে। এতে সব শিক্ষার্থীর শিখন সম্ভব হয় না। অনেক শিক্ষার্থী শিখন অর্জনে চ্যালেঞ্জে পড়ে। আবার বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হয়তো হুট করেই শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত বিদেশের মতো নামিয়ে আনা যাবে না। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের সংখ্যা ও মান যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি শিক্ষকদের ভালো বেতন-মর্যাদা ও পদোন্নতির বিষয়টিও ভাবতে হবে।
আরেকটি বিষয়। শুধু নতুন নতুন নীতি করলেই হবে না, সেটি বাস্তবায়নে শতভাগ আন্তরিক হতে হবে। সংকটগুলো চিহিৃত করে সেগুলোর সমাধান করতে হবে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শ্রেণিশিক্ষক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষা কর্মকর্তাদের জন্য শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে করণীয় নির্ধারণ করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) কিছু নির্দেশনা জারি করেছে। এগুলোর কতটা বাস্তবায়ন হচ্ছে?
ওই নির্দেশনায়, শ্রেণি শিক্ষকদের এখানে শিখন শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা, গতানুগতিক শিক্ষককেন্দ্রিক পদ্ধতি পরিহার করে সহায়তাকারীর ভূমিকা পালন করা, প্রকল্পভিত্তিক কাজ ও অনুসন্ধানমূলক কাজে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত, সমস্যা চিহ্নিত করা, মূল্যায়নের মূলনীতি অনুসরণসহ অনেকগুলো নির্দেশনা দেওয়া আছে। এগুলো নিশ্চিত করতে হবে।
একইভাবে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত বিদ্যালয়ে যাওয়া, শ্রেণি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা, মানসিক বিকাশের জন্য খেলাধুলায় অংশ নেওয়া, এনসিটিবি প্রণীত পাঠ্যপুস্তক ও সম্পূরক পঠনসামগ্রী পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলাসহ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আবার অভিভাবকদের জন্য সন্তানদের বাড়ির ছোট ছোট কাজগুলো করানোর বিষয়ে উৎসাহ প্রদান করা, ভালো কাজে উৎসাহ দেওয়া, সততা ও নৈতিকতা বজায় রাখাসহ নানা বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অভিভাকদের সঙ্গে এসব নিয়ে কথা বলতে হবে। এসব নিয়ে সারাদেশে সচেতনতা জরুরি।
একইভাবে প্রতিষ্ঠান প্রধানকে শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করা, শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়মিত বিষয়ভিত্তিক আলোচনা, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষকসহ অংশীজনের সক্রিয় সমর্থন ও অংশগ্রহণের জন্য সমন্বিত গণযোগাযোগ কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা, শিক্ষকদের ইনহাউজ প্রশিক্ষণসহ নানা বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া আছে। এগুলো নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং দপ্তরের মধ্যে সমন্বয় জরুরি।
আরেকটা কথা। একটা দেশের সব শিক্ষার্থীকে কেন উচ্চ শিক্ষার সনদ নিতে হবে? উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে তারা শিক্ষায় যতটা উন্নত, তার চেয়ে বেশি উন্নত যুগোপযোগী শিক্ষায়, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায়। অথচ বাংলাদেশ এক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে। নতুন শিক্ষাক্রমে এই বিষয়গুলোতে নজর দেওয়া উচিত। তবে সবার আগে যারা শেখাবেন সেই শিক্ষকদের বোঝানো এবং শিক্ষকদের সংকট করাটাই জরুরি। অবশ্য সরকার বলছে তারা নিয়মিত এসব বোঝার চেষ্টা করছেন।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) বলছে, নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের তথ্য সংরক্ষণ ও রিপোর্ট কার্ড প্রস্তুতের বিষয়ে নানা প্রশ্নের উত্তর জানাতে একটি অ্যাপ করা হয়েছে। পাশাপাশি নতুন শিক্ষাক্রমে কী কী সমস্যা হচ্ছে, তা চিহ্নিত করে শিক্ষক-অভিভাবকদের জানাতে অনুরোধ করেছেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। নতুন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক নিয়ে মিথ্যাচার করে প্রচারণা চালানো হচ্ছে জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ৩০ অক্টোবর দুপুরে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে সংবাদ সম্মেলন করে ১৫টি বিষয়ের ব্যাখা দিয়েছেন। এর অগে পরে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তিনি একাধিকবার বলেছেন, ‘‘প্রথমে হয়ত কিছু ভুল-ভ্রান্তি হতে পারে। পাইলটিং শেষ করার আগে সেগুলো সংশোধন সম্ভব হবে। শুধু পাইলটিং নয়, পরের বছরগুলোতেও কোনো সমস্যা বেরিয়ে এলে শিক্ষাক্রমে ধারাবাহিকভাবে পরিবর্তন আনা হবে।”
দীপু মনি বলেছেন, ‘‘এটি হুট করে হয়নি। ২০১৭-১৮ সালে অনেকগুলো গবেষণার পর ২০১৯ সালে সিদ্ধান্ত হয়ে আজকে আমরা এ অবস্থায় এসেছি। এটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হবে ২০২৭ সাল পর্যন্ত। একটি দীর্ঘ সময় নিয়ে, অসংখ্য বিশেষজ্ঞদের কাজের মধ্য দিয়ে আমরা এ জায়গায় এসেছি। আমাদের বইগুলো এখনো বলছি পরীক্ষামূলক সংস্করণ। আমরা ক্রমাগত এর পরিমার্জন ও পরিশীলন করবো।''
নতুন শিক্ষাক্রমে পড়াশোনা নেই, পরীক্ষা নেই, শিক্ষার্থীরা কিছু শিখছে না বলে যেসব কথা বলা হচ্ছে সেগুলো সঠিক নয় দাবি করে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, "শিক্ষার্থীরা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি পড়বে, নিজেরা সক্রিয়ভাবে পড়বে, শিখবে। দলগত কাজ করে আবার তা নিজেরাই উপস্থাপন করবে, শুধু জ্ঞান নয়, দক্ষতাও অর্জন করবে।"আর মূল্যায়ন হবে প্রতিটি কাজের। আবার ষান্মাসিক মূল্যায়ন এবং বার্ষিক মূল্যায়নও হবে। কাজেই পরীক্ষা ঠিকই থাকছে, কিন্তু পরীক্ষার ভীতি থাকছে না। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া এবং না হওয়া আছে, শুধু তাই নয়, পারদর্শিতার সাতটি স্কেলে তাদের রিপোর্ট কার্ডও আছে।”
দীপু মনি বলেন, ‘আমাদের নতুন শিক্ষাক্রম একেবারে রূপান্তর। আমরা যখন পড়াশোনা করেছি, তখন একটি নতুন প্রযুক্তি এসেছে ১০-১৫ বছর বিরতিতে। এখন ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে নতুন নতুন প্রযুক্তি আসছে।
এখন আমাদের শিক্ষার্থীরা যে জগতে বড় হবে, সেখানে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে সমন্বয় করে নেতৃত্বের জায়গায় টিকে থাকতে হবে।''
তবে সময়েই বলে দেবে নতুন শিক্ষাক্রম কোন পথে যাচ্ছে আর নতুন প্রযুক্তি নতুন সময়ের সঙ্গে সমন্বয় করে কতটা এগুতে পারছে বাংলাদেশ!
গত বছরের ছবিঘরটি দেখুন...