শিক্ষামন্ত্রীর ক্ষমা চাওয়ায় কি এমন রাজনৈতিক সমাবেশ বন্ধ হবে?
২৯ জুলাই ২০২২সব রাজনৈতিক দলের নেতারাই মনে করেন, এটা ঠিক হচ্ছে না, কিন্তু তারপরও হচ্ছে।
সম্প্রতি ঢাকার দক্ষিণখানে একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে থানা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়েছে। সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন খোদ শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। সংবাদ মাধ্যমে এ নিয়ে নেতিবাচক খবর প্রকাশিত হলে বৃহস্পতিবার মন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছেন, ওই সমাবেশে অংশ নিয়ে তিনি লজ্জিত ও বিব্রত হয়েছেন। এ জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন তিনি।
গত সোমবার রাজধানীর দক্ষিণখানের চেয়ারম্যান বাড়ি এলাকায় এস এম মোজাম্মেল হক শিক্ষা কমপ্লেক্সের মাঠে থানা ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী। তিনি বলেন, "প্রকৃতপক্ষে আমি খুবই বিব্রত বোধ করছি। আমি গত পরশুদিন ঢাকায় একটি রাজনৈতিক সমাবেশে গিয়েছিলাম। আমি চলে আসার পর জেনেছি, সেখানে আশপাশে বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তারা ওই মাঠ ব্যবহার করে। সেখানে সেই রাজনৈতিক সমাবেশটি হয়েছে। পরে আমি খোঁজ নিয়েছি। আমাকে বলা হলো, সকাল নয়টা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম চলেছে। আসলে কতটা চলেছে সেটা আমি জানি না। ওখানে যখন প্যান্ডেল করা হয়েছে, তখন শিক্ষা কার্যক্রম একেবারে নির্বিঘ্নে হয়েছে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। সে কারণে আমি সত্যিই ভীষণভাবে লজ্জিত।”
ক্ষমা চাওয়ার এই সংস্কৃতি এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাবে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "বাংলাদেশে তো কেউ অন্যায় করে স্বীকার করেন না। শিক্ষামন্ত্রী যেটা করেছেন সেটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আমি মনে করি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চলাকালে সেখানে কোনোভাবেই রাজনৈতিক বা সামাজিক অনুষ্ঠান করা যাবে না। এ সংক্রান্ত আইনও আছে। এখন শিক্ষা মন্ত্রনালয়কে সেটা দেখভাল করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর এ ধরনের সংস্কৃতি পরিতাজ্য করা উচিৎ বলেই আমি মনে করি। আগে তো এলাকায় কোনো নেতা গেলে শিক্ষার্থীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখা হতো। এখন সেই প্রবণতা অনেকটা কমেছে। তবে হ্যাঁ ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যদি কেউ যান, তাকে শিক্ষার্থীরা অভ্যর্থনা জানাতেই পারে। কিন্তু কোমলমতি শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক কাজে যেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে সেটা পরিতাজ্য।”
গত ২৩ মে সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে এস. কে পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ রেখে স্কুলের মাঠে উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে প্রায় ১ হাজার ৩০০ শিক্ষার্থী ক্লাস বঞ্চিত হয়। এ ছাড়া স্কুলে ওই দিন একটা পরীক্ষা হওয়ার কথা থাকলেও সেটি পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। জানা গেছে, ওই দিন সকালে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে গেলে পাঠদান না করিয়ে শুধু হাজিরা নিয়ে ছুটি দেওয়া হয়। যে পরীক্ষা ছিল, সেটি পিছিয়ে পরের একটি দিন নির্ধারণ করা হয়।
স্কুল চলাকালে কেন রাজনৈতিক দলের সম্মেলনের অনুমতি দেয়ার কারণ জানতে চাইলে স্কুলের প্রধান শিক্ষক শহিদুর রেজা ডয়চে ভেলেকে বলেন, "স্থানীয় সংসদ সদস্য আমাদের মাঠ ব্যবহার করতে চেয়েছেন, সেক্ষেত্রে আমাদের সেটা দিতেই হয়। আর সকালেই ছুটি দেওয়া হয়নি। একটা-দু'টো ক্লাসও হয়েছে। পরে সম্মেলনের লোকজন এলে ছুটি দেওয়া হয়। আর যে পরীক্ষার কথা বলা হচ্ছে, সেটা কোনো পাবলিক পরীক্ষা না, মাসিক পরীক্ষা। ফলে যে কোনোদিন ওই পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব।”
এই সম্মেলনে প্রধান বক্তা ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন। স্কুল চলাকালে আওয়ামী লীগের সম্মেলনের বিষয়ে জানতে চাইলে ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "এটা একেবারেই প্রত্যাশিত নয়। আমি এটা জানতাম না। স্কুল বন্ধ রেখে সম্মেলনের কোনো সুযোগ নেই। গত কয়েক মাসে আমি ৭৮টি উপজেলায় সম্মেলন করেছি। একটিও স্কুল খোলার দিন করিনি। এটা কিভাবে হয়েছে, আমি বুঝতে পারছি না। ভবিষ্যতে আমি আরো বেশি সচেতন থাকবো।”
স্কুল মাঠেই কেন এই আয়োজন করতে হলো? এ প্রসঙ্গে বেলকুচি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পৌর মেয়র বেগম আশানুর বিশ্বাস ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এমপি মহোদয় তারিখ ও স্থান নির্ধারণ করলে আমাদের তো যেতেই হয়। স্থান ও তারিখের ব্যাপারে আমাদের কোনো হাত ছিল না। উনি আমাদের সঙ্গে আলোচনা করেও এটা করেননি। নিজে যা ভালো মনে করেছেন সেটাই করেছেন। সম্মেলনে আমি সভাপতি প্রার্থী ছিলাম। ফলে আমার বিরোধিতার সুযোগ ছিল না।”
এ বিষয়ে জানতে স্থানীয় সংসদ সদস্য আবদুল মমিন মন্ডলের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। তবে সিরাজগঞ্জ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এ কে এম শফিউল্লাহ বলেছেন, "স্কুল বন্ধ রেখে কোনো রাজনৈতিক দলের সম্মেলন করার অনুমোদন দেওয়ার কোনো বিধান নেই। এ বিষয়ে কেউ আমাকে অবগত করেনি। প্রধান শিক্ষক চাইলে বছরে চারদিন স্কুল বন্ধ রাখতে পারেন। যদি সম্মেলনটি এ বন্ধের মধ্যে পড়ে তাহলে ঠিক আছে।”
শুধু এই দু'টি ঘটনা নয়, গত দুই মাসে আরো বেশ কয়েকটি সম্মেলন হয়েছে স্কুল বন্ধ রেখে, যার সবগুলোই সরকারি দল আওয়ামী লীগের। গত ৩১ মে ১৯ বছর পর লক্ষীপুরের রায়পুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। স্থানীয় মার্চেন্টস অ্যাকাডেমি উচ্চবিদ্যালয় বন্ধ করে এই সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। অভিভাবকরা স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে বলেছেন, যখন যে সরকার আসে, তখন তারাই ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে স্কুল বন্ধ করে সমাবেশ করে।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল খোকন বলেছেন, "কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই বিদ্যালয় মাঠে সম্মেলন করা হয়েছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ না চাইলে অনুমতি দিতো না।” তবে রায়পুর মার্চেন্টস অ্যাকাডেমির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. হুমায়ুন কবির বলেছেন, "আওয়ামী লীগের সম্মেলনের জন্য নেতারা অনুমতি চেয়েছিলেন। অনুমতি দেওয়া ছাড়া আর কি কোনো বিকল্প ছিল? ফলে অনুমতি দিয়েছি।”
গত ১৮ জুলাই ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর মহিলা কলেজ ছুটি দিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য রমেশ চন্দ্র সেন প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য দবিরুল ইসলামও সেখানে ছিলেন। কলেজ বন্ধ দিয়ে সম্মেলনের আয়োজন করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অভিভাবকরা। তারা বলছেন, করোনাকালে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় অনেকটাই পিছিয়ে গেছে। এর ওপর সামনে এইচএসসি পরীক্ষা। এ সময় কলেজ ছুটি দিয়ে মাঠে রাজনৈতিক দলের সমম্মেলনের আয়োজন করা ঠিক হয়নি। অভিভাবকরা বলেছেন, সম্মেলনটি আলাদা কোনো খোলা মাঠে করা যেতো। এতে করে প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হতো না।
হরিপুর মহিলা কলেজের প্রিন্সিপাল জিয়াউল হাসান স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেছেন, "একদিনে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার তেমন কোনো ক্ষতি হবে না।”
দীর্ঘদিন ধরে চলা এই সংস্কৃতি বিএনপির শাসনামলেও ছিল। সামনের দিনে এই সংস্কৃতি থেকে বের হওয়ার কোনো চিন্তা আছে কিনা জানতে চাইলে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইমরান সালেহ প্রিন্স ডয়চে ভেলেকে বলেন, "হ্যাঁ, আমরা স্কুলে সম্মেলন করেছি। কিন্তু সেটা স্কুল বন্ধ করে না, স্কুল ছুটির পর। এখন করোনায় অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। এর মধ্যে খোদ শিক্ষামন্ত্রী স্কুল বন্ধ রেখে সম্মেলনে যান কিভাবে? উনি শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করেছেন। উনার কাছে তো প্রোগ্রাম শিডিউল আগে থেকেই ছিল। তাহলে উনি জানতেন না, এটা কিভাবে বলেন? তবে রাজনৈতিক দলের জন্য এখন যে সমস্যটি হয়েছে, রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের কোনো মাঠ নেই। পল্টন ময়দান অন্য কাজে ব্যবহার হয়ে গেছে। মুক্তাঙ্গন বন্ধ করে দিয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বিএনপির জন্য সরকার নিষিদ্ধ করে রেখেছে। আর মাঠগুলো সরকারি দলের লোকেরা দখল করে নিয়েছে। ফলে স্কুলের মাঠ ছাড়া বড় সমাবেশ করা আসলেই কঠিন। বিএনপি কখনো ক্ষমতায় গেলে স্কুল বন্ধ করে রাজনৈতিক সম্মেলন করবে না, এটা আমি দায়িত্ব নিয়েই বলছি।”